যে কোনও প্রকল্প শুরুর ক্ষেত্রে যেটা অন্যতম প্রধান সমস্যা, সেই জমির বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছে চার বছর আগেই। ইতিমধ্যে কেন্দ্রে এ রাজ্য থেকে দু-দু’জন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীও পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আবু হাসেম খান চৌধুরী)। অথচ, রাজারহাটে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দফতরের অধীনস্থ চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে একটা ইটও গাঁথা হয়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রক স্তরে অবশ্য হেলদোল নেই। চিত্তরঞ্জনের কর্তারাই বলছেন, চার বছর ধরে দফায়-দফায় বৈঠকই চলছে। কাজ আর এগোচ্ছে না। ১০ একর জমি খাঁ-খাঁ করছে। অথচ, হাজরার ৫০ বছরের পুরনো প্রথম ক্যাম্পাসে জায়গার অভাবে ভর্তি হতে না-পেরে প্রতিদিন ফিরে যেতে হচ্ছে বহু গুরুতর অসুস্থ ক্যানসার রোগীকে। কারণ, পূর্ব ভারতে শুধু ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য এমন সরকারি হাসপাতাল আর নেই। কিন্তু দ্বিতীয় ক্যাম্পাস না-থাকায় অনেক রোগী আউটডোরে দেখানোর আড়াই-তিন মাস পরে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। তত দিনে রোগ অনেকটা ছড়িয়ে পড়ছে।
এই দেরির পিছনে কি শুধু লাল ফিতের ফাঁস, না অন্য কারণ রয়েছে? রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কয়েক জন কর্তা জানান, কেন্দ্র-রাজ্যের টানাপোড়েনই মূল কারণ। যার জেরে এই প্রকল্পের জন্য এক টাকাও পাঠায়নি কেন্দ্র। কংগ্রেসের আবু হাসেম খান চৌধুরী স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরে মাত্র কয়েক মাস আগে গত নভেম্বরে ৬৫০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে কেন্দ্র। হাসপাতাল পেয়েছে মাত্র ২৫ লক্ষ। সেই টাকা বিভিন্ন বিভাগের ছাড়পত্র জোগাড়েই ব্যয় হয়ে গিয়েছে। পরবর্তী টাকা না এলে হাসপাতাল তৈরি করা যাবে না। এ রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা বিশ্বাস বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে কেন্দ্র কতটা উদাসীন, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।”
অভিযোগ মানতে নারাজ কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্তারা। কেন্দ্রের যুগ্মসচিব অংশু প্রকাশের কথায়, “এটা ঠিক নয়। কোনও রাজ্যের প্রতি আমাদের বৈমাত্রেয় মনোভাব নেই। সরকারি কাজ শুরু করতে নিয়মকানুনের জন্য একটু দেরি হয়। যোজনা কমিশন থেকে টাকা পাশ হতে সময় লেগেছে।” তাঁর আরও বক্তব্য, “প্রথমে ঠিক হয়, একটি পর্বেই ৩০০ শয্যার হাসপাতাল হবে। পরে ঠিক হয়, দু’টি পর্বে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল হবে। ফের নকশা তৈরিতে সময় লাগে। আশা করছি, আগামী তিন মাসের মধ্যে কাজ শুরু হবে।” |
যা শুনে ক্ষুব্ধ কেন্দ্রের পূর্বতন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সব মিথ্যা। ইচ্ছাকৃত দেরি। আমি মন্ত্রী থাকাকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী গুলাম নবি আজাদকে তিনটি নোট পাঠিয়ে কাজ শুরুর আবেদন করি। হাসপাতালের কর্তাদের নিয়ে ওঁর সঙ্গে চার বার আলোচনায় বসেছি। উনি গা-ই করতেন না। যোজনা কমিশন টাকা ছাড়ল না। অথচ, গুলাম নবি আজাদই নিজে কমিশনের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি ক্যানসার হাসপাতালের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান। গত তিন বছরে উনি অবশ্য গভর্নিং বডির কোনও বৈঠকে যাননি।” সুদীপবাবুর কথায়, “কত বার গুলাম নবিকে অনুরোধ করেছি, আমাকে ক্যানসার হাসপাতালের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান করে দিন। তা হলে প্রকল্পটা দ্রুত বার করে আনতাম। পশ্চিমবঙ্গের প্রতি ওদের কত বিদ্বেষ, এ থেকে বোঝা যায়।” সুদীপবাবুর যুক্তি খণ্ডন করে বর্তমান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আবু হাসেম খান চৌধুরীর দাবি, “পদে থাকাকালীন ক্যানসার হাসপাতালের কাজ এগিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র উদ্যোগী হননি সুদীপবাবু। আমি এসে দিল্লিতে দরবার করে টাকা বার করে এনেছি। এ বার হাসপাতালও করে দেব।”
এই তরজায় থাকতে চাইছেন না হাসপাতালের কর্তারা। কেন্দ্র-রাজ্য দড়ি টানাটানিতে দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ আরও পিছিয়ে না যায়, এই আশঙ্কা তাঁদের। অধ্যক্ষ রাজদীপ বিশ্বাস জানান, পুরনো ক্যাম্পাসে ২০৮ শয্যার একটিও কখনও খালি থাকে না। বছরে সাত-আট হাজার রোগী আসেন, যার মধ্যে হাজারখানেক নতুন রোগী। সংখ্যাটা বাড়ছে, যার চাপ এই পুরনো ক্যাম্পাসের পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। নতুন ক্যাম্পাস চালু না হলে বহু গরিব রোগীকে শুধু চিকিৎসা পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষায় থাকতে হবে। |