আইন বলছে, লিঙ্গ নির্ধারণ বা কন্যাভ্রূণ হত্যা করলে কড়া সাজা হবে ডাক্তার, রেডিওলজিস্টের। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ রাজ্যে তেমন কাজ করে ধরা পড়েননি এক জনও। ফলে এই অপরাধ রুখতে রাজ্য সরকার ও চিকিৎসক সংগঠনের ভূমিকা কী, তা-ও স্পষ্ট নয়।
আর অপরাধের কথা জানা থাকা সত্ত্বেও তার দাওয়াই নিয়ে ধোঁয়াশার কথা জানিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী নিজেই। সম্প্রতি দুর্গাপুরে এক কর্মশালায় গিয়ে তিনি বলেন, “এটা স্পষ্ট যে ব্যাপক হারে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করা হচ্ছে। কিন্তু তার জন্য ক’টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার শাস্তির মুখে পড়েছে, তার কোনও স্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই।”
কন্যাভ্রূণ হত্যা আটকাতে ১৯৯৪ সাল থেকে ‘প্রি-কনসেপশন অ্যান্ড প্রি-ন্যাটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিকস (পিসি অ্যান্ড পিএনডিটি) অ্যাক্ট’ চালু হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত গোটা দেশে মাত্র ৮০৫টি মামলা রুজু হয়েছে। শাস্তি পেয়েছেন সাকুল্যে ৫৫ জন। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, দেশে প্রতি হাজার পুরুষে নারীর সংখ্যা ৯১৪। রাজ্যে এই হার ৯৫০। কিন্তু কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় শিশুকন্যার সংখ্যা বছর-বছর কমছে। যে জেলায় কর্মশালা হয়েছে, সেই বর্ধমানে তা মোটে ৯০৩। গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে হার আরও কম। |
বছর কয়েক আগে রাজ্য মহিলা কমিশন কলকাতায় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে একটি সমীক্ষা করে। স্বাস্থ্য দফতরে তার রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছিল। তাতেও দেখা যায়, কয়েকটি ওয়ার্ডে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বিপজ্জনক মাত্রায় কমছে। পিএনডিটি-র সুপারভাইজরি বোর্ডের ভাইস চেয়ারপার্সন শশী পাঁজার মতে, “এই সব তথ্য থেকেই পরিষ্কার, ব্যাপক হারে কন্যাভ্রূণ হত্যা হচ্ছে।” কিন্তু এই অপরাধে আজ পর্যন্ত যত চিকিৎসকের শাস্তি হয়েছে, তার এক জনও এই রাজ্যের নন। লিঙ্গ নির্ধারণের অভিযোগে এক জনও চিকিৎসক তথা রেডিওলজিস্টকে ধরা গেল না কেন, অভিযুক্ত কয়েকটি ক্লিনিকের লাইসেন্স মাত্র কয়েক মাসের জন্য বাজেয়াপ্ত করে ছেড়ে দেওয়া হল কেন এই সব প্রশ্নেরও সদুত্তর মেলেনি।
স্বাস্থ্য অধিকর্তার দাবি, “আমাদের ক্লিনিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট এখনও এতটা কড়া নয় যে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের অপরাধে ক্লিনিকের লাইসেন্স চিরদিনের মতো বাতিল করে দেব। আমরা নিয়ম সংশোধনের চেষ্টা করছি।” কর্মশালায় তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ডায়গনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টে ইংরেজি হরফে ‘6’ লিখে কাটাকুটি করে দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু ‘6’ অনেকটা ‘b’ অক্ষরের মতো দেখতে, বোঝা যায় ভ্রূণটি ‘boy’ অর্থাৎ পুরুষ-শিশুর। কন্যাভ্রূণের ক্ষেত্রে আবার ‘9’ লেখা হয়, যা কিছুটা ‘g’ অক্ষরের মতো দেখতে। অর্থ, ভ্রূণটি ‘girl’ বা শিশুকন্যার। বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তি দিতে ‘ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশনে’র উদ্ভব হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক ক্রোমোজোম দেখে বুঝতে পারেন, ভ্রূণ পুরুষের না স্ত্রী-র। সেই সুযোগেও লিঙ্গ নির্ধারণের কারবার চলছে।
শশীদেবী বলেন, “ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ হচ্ছে জেনেও যে আমরা ধরতে পারছি না, তার প্রধান কারণ রোগী নিজেই এটা সমর্থন করছেন। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে কে?” লিঙ্গ নির্ধারণ আটকাতে কী ব্যবস্থা নিয়েছে চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন? সংগঠনের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা রেডিওলজিস্ট শান্তনু সেনের বক্তব্য, একাধিক বার সচেতনতা শিবির করা হয়েছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও রেডিওলজিস্টদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কোন কোন ক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্বাচন এড়ানোর উপায় নেই। বাকি কোনও ক্ষেত্রেই তা করা যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিকর্তার মতে, “একটা-দু’টো ক্লিনিক বা ডাক্তারকে ধরে শাস্তি দিলেই হবে না। জনসচেতনতা তৈরি করার কর্মসূচি চাই।” কিন্তু চিকিৎসক বা প্রশাসকদের সচেতন করবে কে, বৃহস্পতিবার কন্যাদিবসে সেই প্রশ্নটাই বড় হয়ে উঠেছে। |