ফুলকপি, বেগুন ফলানো ছেড়ে দিয়েছেন আক্রাম বিশ্বাস। তাঁর এক বিঘে জমিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে শ’তিনেক কুলগাছ। সাত-আট ফুট লম্বা। তাহেফ আলিও সব্জি-চাষের পাট চুকিয়েছেন। তাঁর আটত্রিশ কাঠার প্রায় পুরোটা জুড়ে এখন পেয়ারা আর গন্ধরাজ লেবুর রাজত্ব।
শুধু আক্রাম বা তাহেফ নন। উত্তর ২৪ পরগনার ছোট জাগুলিয়ার বরা গ্রামের বহু কৃষকই সব্জি চাষ ছেড়ে বিকল্প চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। কেন?
সব্জি ফলানোর মারকাটারি খরচ, আর ফড়ের দাপটের দিকে আঙুল তুলেছেন আক্রাম। তিনি হিসেব দিলেন, “বীজ, সারের দাম আকাশছোঁয়া। সেচের জল পেতে ঘণ্টায় লাগে একশো টাকা। মাঠে কাজের লোকের মজুরি দিনে দেড়শো। আর এত টাকা ঢেলে সব্জি ফলিয়ে জলের দরে বেচতে হয় ফড়েদের কাছে! চাষের টাকাই তো উঠছিল না! পোষাব কী করে?”
অগত্যা সব্জির বদলে এ বার তিনি কুলগাছ লাগিয়েছেন। এতে লাভ হবে? আক্রাম যথেষ্ট আশাবাদী। “গাছগুলোর এগারো মাস বয়স হল। সার, জল সব মিলিয়ে এক বিঘেতে তিরিশ হাজার টাকার মতো পড়েছে। যা কুল হয়েছে, হেসে-খেলে আশি-নব্বই হাজার পেয়ে যাব।” প্রত্যয়ী সুর তাঁর গলায়। |
আপেল কুলের বাগানে বরা গ্রামের চাষি। ছবি: সুদীপ ঘোষ |
আক্রামের প্রত্যয়ের কারণও আছে। ওঁর গ্রামেরই নজমুস সাকিব ইতিমধ্যে বাগানের কুল বেচে ভাল আয় করেছেন। কুড়ি টাকা কেজি দরে বড় মাপের ওই ‘আপেল কুল’ কিনছেন স্থানীয় পাইকারেরা। আবার সেলিম আলি নিজের খেতে গোটা পঞ্চাশ গন্ধরাজ লেবুর গাছ লাগিয়ে মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা পাচ্ছেন। সেলিমের কথায়, “এই সব গাছ লাগানোর সময়েই যা একটু খরচ। তার পরে নিয়মিত জল, সামান্য সার দিলেই ফলন বাঁধা। আনাজের মতো ঝকমারি নেই। লাভও নিশ্চিত।”
নিশ্চিত লাভের আশাতেই কলকাতার চল্লিশ কিলোমিটার দূরের গ্রামটির চাষিরা ফলের গাছের পাশাপাশি লম্বা এক ধরনের গাছ লাগাচ্ছেন। ওঁদের ভাষায়, ‘লম্বু’ গাছ। পাঁচ-সাত বছরে তালঢ্যাঙা হয়ে যাওয়া এক-একটা লম্বুর দাম দাঁড়ায় প্রায় ছ’হাজার টাকা। তার কাঠ যেমন জ্বালানির কাজ করে, তেমন তা দিয়ে মামুলি আসবাবও তৈরি হয়। কাজেই অনেকের কাছে লম্বু কাঠের বেশ কদর। “আমার পনেরো কাঠার সামান্য ছেড়ে রেখেছি ধানের জন্য। বাকি জমির পুরোটায় লম্বু লাগিয়েছি।” জানালেন শেখ আলাউদ্দিন।
অর্থাৎ, বরার চাষিরা নিজের মতো করে ফড়ের ফাঁস এড়িয়ে বাঁচার পথ খুঁজছেন। জেলা কৃষি দফতরের এক কর্তা বলেন, “এই জেলারই জয়পুর গ্রামে মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি-কে সরাসরি সব্জি বেচে চাষিরা লাভের মুখ দেখেছেন। সংস্থার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সেখানে আনাজের চাষ বাড়ছে।” ওঁর মতে, লাভে ফসল বিক্রির সুযোগ না থাকলে চাষিরা বাধ্য হয়ে ফড়ের জুলুম মেনে নেন। ব্যতিক্রম বরার মতো কয়েকটা গ্রাম।
কিন্তু সর্বত্র এ ভাবে বিকল্প চাষ মাথা তুললে সব্জির সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জেলার ওই কৃষি-কর্তা। যার ছায়া কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-বিজ্ঞানী অমিত চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যে। “ওই চাষের জন্য এ বছরে হাবরা, বাদু এলাকায় ধানচাষ কমে গিয়েছে। এতে মারাত্মক অবস্থা তৈরি হতে পারে।” বলছেন অমিতবাবু। কৃষি-বিজ্ঞানী রথীন্দ্রনারায়ণ বসু অবশ্য এতটা শঙ্কিত নন। তাঁর দাবি: ফড়ে এড়াতে সব্জি চাষ কমিয়ে কুল বা পেয়ারা ফলানোয় ভুল কিছু নেই। কারণ চাষিরা অধিকাংশ সময়ে সব্জির ঠিক দাম পান না, যেখানে পাইকারি বাজারে কুল-পেয়ারার দর যথেষ্ট। “তবে চাষিদের উচিত, নিজেদের মধ্যে কথা বলে সব্জি ও কুল-পেয়ারা ইত্যাদির চাষে একটা ভারসাম্য বজায় রাখা। ওঁদের নিজেদের স্বার্থেই এটা দরকার, কেননা সকলে একই চাষ শুরু করলে ওঁদেরই সমস্যায় পড়তে হবে,” বলেন রথীন্দ্রনারায়ণবাবু।
কৃষি-বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, রাজ্য সরকারই চাষিদের সঙ্গে আলোচনা করুক। যদিও ফড়ের অত্যাচারে বিকল্প চাষ বেছে নেওয়ার প্রবণতার ‘বিপদ’ সম্পর্কে এই মুহূর্তে বিশেষ মাথা ঘামাতে রাজি নন রাজ্যের কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না। বরার কথা শুনে তাঁর মন্তব্য, “ও সব কিছু নয়। যাঁরা চাষ করতে পারছেন না, জমি দখল রুখতে ফলগাছ লাগাচ্ছেন।”
বরার চাষি অবশ্য এমনটা ভাবছেন না। বরং ওঁরা দেখছেন, তাঁদের গ্রামে ‘বিকল্প’ চাষের রমরমা আশপাশের গ্রাম-গঞ্জেও সাড়া ফেলেছে। সেখানেও ক্রমশ বাড়ছে পেয়ারা-গন্ধরাজ লেবু-লম্বুর চাষ। নাজমুসের কথায়, “ক’বছর পর এই তল্লাটে এলে দেখবেন, সব খেত কুল-গন্ধরাজ-পেয়ারায় ভর্তি। দেখবেন, অনেকে স্রেফ লম্বু গাছ লাগিয়ে জমি ফেলে রেখে দিয়েছে। সব্জি চাষ বিলকুল উধাও হয়ে গিয়েছে!” |