মুখ্যমন্ত্রীর সফর সত্ত্বেও ফেরেনি জঙ্গলমহলের স্বাস্থ্য |
পালাবদলের পরে অন্তত ১৩ বার সপার্ষদ জঙ্গলমহল সফর করেছেন তিনি। জনসভায় মাওবাদী প্রভাবিত প্রান্তিক গ্রাম থেকে আসা মানুষজনকে আশ্বাস দিয়েছেন, ‘এখানেই সব পরিষেবা এনে দিচ্ছি। চিকিৎসার জন্য আর ভেল্লোর যেতে হবে না।’ ‘জঙ্গলমহল হাসছে’ রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপনে তাঁরই হাসিমুখ। তিনি, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের পূর্ণমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর বিজ্ঞাপিত জঙ্গলমহলের সেই স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন খোদ মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র।
বছরের প্রথম দিনেই খাদ্যসচিব অনিল বর্মাকে এক পাতার সংক্ষিপ্ত চিঠি দিয়ে (০২(৩)-সিএস/২০১৩) মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, বামপন্থী জঙ্গি সংগঠন (এলডব্লুই) বা মাওবাদী প্রভাবিত জেলাগুলির কয়েকটি গ্রামে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প খতিয়ে দেখতে তিনি ‘র্যাপিড সার্ভে’ করেছেন। চিঠির সঙ্গেই জোড়া হয়েছে সমীক্ষার চার পাতার রিপোর্ট। যা বলছে, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার পাঁচ ব্লকের অন্তত ৩৫টি গ্রামে বেশির ভাগ বাসিন্দাই যক্ষ্মা এবং সিলিকোসিসে ভুগছেন। থাবা বসাচ্ছে ম্যালেরিয়া, জাপানি এনসেফেলাইটিসও।
আর স্বাস্থ্য পরিকাঠামো?
মুখ্যসচিবের পর্যবেক্ষণ: বাঁকুড়ার বারিকুল, পুরুলিয়ার বান্দোয়ান বা পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি, শালবনি, গোয়ালতোড় ব্লকের ওই সব গ্রামে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (এনআরএইচএম) আওতায় মেরে-কেটে ৩৩% চিকিৎসকও নিয়োগ করা যায়নি। প্রায় অগম্য ওই গ্রামগুলিতে সচিব ‘নিজে গিয়ে দেখেছেন’, মিশনের আওতাভুক্ত ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র দেখভালের কেউ নেই। জঙ্গলমহল জুড়ে ‘বিরাজ করছে অস্তিত্বহীন এক নজরদারির পরিবেশ’। প্রত্যন্ত ওই এলাকাগুলিতে চিকিৎসক নিয়োগ করতে বেশি উৎসাহ ভাতা দেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
সমীক্ষা বলছে, কেন্দ্রের ‘রিভাইসড ন্যাশনাল টিবি প্রোগ্রাম’-এর আওতায় যক্ষ্মা আক্রান্তদের ‘ডট’ চিকিৎসা হচ্ছে ঠিকই, তবে ওষুধ খেলেই অনেকের বমি ভাব দেখা যাচ্ছে। ফলে, অনেকেই দ্বিতীয় বার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পা বাড়াচ্ছেন না। চিকিৎসকদের অনুমান, সুদূর গ্রাম থেকে আসা রোগীরা অনেকেই খালি পেটে থাকে। ফলে ওষুধ পড়তেই গা-গুলিয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে তাঁদের জন্য কলা-পাঁউরুটির বন্দোবস্ত রাখা জরুরি বলেও মত মুখ্যসচিবের।
গ্রামের হেজে-মজে যাওয়া পুকুর- ডোবা ম্যালেরিয়ার আঁতুড় হিসেবে চিহ্নিত। মুখ্যসচিবের মতে, সেগুলিতে এলএলআই জাল ব্যবহারের জন্য প্রচার চালানো প্রয়োজন। জাপানি এনসেফেলাইটিস রুখতে শুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহেরও দরকার আছে। তার জন্য গ্রামে ৬০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা খরচে ২৫০-৩৫০ ফুট গভীর ‘মার্ক-২’ নলকূপ বসানো প্রয়োজন। এ কাজে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের সক্রিয় হওয়া দরকার বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গ্রামগুলিতে মোবাইল মেডিক্যাল ভ্যান যে সহজলভ্য নয়, তা-ও সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ২০০৮ সালে বেলপাহাড়িতে মাওবাদীদের পেতে রাখা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছিল এমনই এক মোবাইল ভ্যান। সাময়িক ভাবে থমকে যায় মোবাইল মেডিক্যাল ভ্যান। পরে চালু হলেও তা যে নিছক নিয়মরক্ষার, রিপোর্টে সে কথাও উঠে এসেছে।
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সরকারি প্রতিশ্রুতির ২ টাকা কেজি দরে চাল তেমন অপ্রতুল নয়। সে চালের চাহিদাও রয়েছে। কিন্তু ওই চাল অনেক সময়ে খোলা বাজারে বিক্রি করে সেই ‘উপরি আয়ে’ গ্রামবাসীদের অনেকেই মদ্যপান করছেন। বিষয়টি চোখ এড়ায়নি রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকেরও। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্কও করেছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপনে মুখ্যমন্ত্রী যতই হাসুন, জঙ্গলমহল কি সত্যিই হাসছে? |