আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে না বলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় নিয়ম করেই তোপ দাগছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তাঁর স্বাস্থ্য দফতরেই উল্টো চিত্র।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, মা ও শিশু-র স্বাস্থ্য ও কন্যাভ্রূণ হত্যা রোধের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে কেন্দ্রের দেওয়া টাকার ৮২ শতাংশই খরচ করতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের অবশ্য দাবি, কেন্দ্রের রিপোর্ট ভুল। রাজ্যে ভাল ভাবেই কাজ হচ্ছে। কিন্তু তার খতিয়ান পেশ করতে গিয়ে রাজ্য মৌখিক ভাবে যে হিসেব দিয়েছে, তাতেও দেখা গিয়েছে চলতি আর্থিক বর্ষে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের বরাদ্দ টাকা ৪০ শতাংশও খরচ হয়নি। স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে, জেলা থেকে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট চেয়ে পাঠানো হচ্ছে। তা হলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে।
চলতি আর্থিক বর্ষ (২০১২-১৩) শেষ হতে এখনও দু’মাস বাকি। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এর মধ্যে এনআরএইচএম খাতে কেন্দ্রের বরাদ্দ ১৪০০ কোটি টাকার মধ্যে রাজ্য এখনও পর্যন্ত মাত্র ২৫০ কোটি টাকার কিছু বেশি খরচ করতে পেরেছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রিপোর্ট অন্য কথা বলছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে: গর্ভবতী, সদ্যপ্রসূতি, সদ্যোজাতের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দেওয়া প্রায় ৭৩০ কোটি টাকার মধ্যে সাকুল্যে এখনও পর্যন্ত ১৫২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অর্থাৎ, টাকা খরচের হার মাত্র ২১ শতাংশ। হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নত করা, গ্রাম ও ব্লক স্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করা, ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য ইউনিট, গর্ভবতীদের জন্য ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য ইউনিট, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প, ওষুধ কেনা, প্রচার ইত্যাদি খাতে কেন্দ্র অনুমোদন করেছিল আরও প্রায় ৭৪৫ কোটি টাকা। এই খাতে রাজ্য এখনও পর্যন্ত টেনেটুনে খরচ করতে পেরেছে ১০২ কোটির মতো। এ ক্ষেত্রে টাকা খরচের হার মাত্র ১৩ শতাংশ। |
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের (এনআরএইচএম) টাকা সময় মতো খরচ করতে না পারায় গত ডিসেম্বরের একেবারে শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দফতরকে ভর্ৎসনা করে কড়া চিঠিও পাঠিয়েছে কেন্দ্র। কেন এত কম টাকা খরচ হয়েছে, জানতে চেয়েছে তারা।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বক্তব্য, গত বছর ফেব্রুয়ারি এবং জুন মাসেও তারা এ ব্যাপারে রাজ্যকে সতর্ক করে দিয়েছিল। তার পরেও এনআরএইচএম-এর টাকা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কোনও উন্নতি করতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গ।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকে এনআরএইচএমের অধিকর্তা রবীন্দ্র পাত্তর বলেছেন, “এত দিন টাকা খরচ করতে না-পারলেও আমরা রাজ্যগুলিকে পরের আর্থিক বছরের টাকা পাঠিয়ে দিতাম। কিন্তু দেখছি, এতে তাদের সময়ে কাজ না-করার প্রবণতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গকে তাই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ বার টাকা খরচ না হলে এবং খরচের সব ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট না-পেলে পরবর্তী আর্থিক বছরের জন্য এই খাতে আর টাকা মঞ্জুর করা হবে না।”
কেন্দ্রীয় সরকার যা-ই বলুক না কেন, টাকা খরচ না হওয়ার অভিযোগ মানতে চাননি রাজ্যের স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “ওঁরা চিঠি পাঠালেই কি মেনে নিতে হবে যে টাকা খরচ হয়নি? আমাদের এনআরএইচএম-এ প্রচুর কাজ হয়েছে।” কী কী কাজ হয়েছে? এর উত্তর অবশ্য চন্দ্রিমাদেবীর কাছে মেলেনি। রাজ্যে এনআরএইচএমের অধিকর্তা সঙ্ঘমিত্রা ঘোষকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,“এটা রুটিন চিঠি। সব রাজ্যকেই পাঠানো হয়।” রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব সতীশ তিওয়ারির দাবি, খরচের হিসেবে ভুল করেছে কেন্দ্র। তাঁরা সেটা দিল্লিকে লিখেও পাঠাচ্ছেন।
কী ধরনের ভুল?
স্বাস্থ্য সচিবের ব্যাখ্যা, “গর্ভবতী, মা ও শিশু খাতে আমাদের টাকা খরচের হার মোটেই ২১ শতাংশ নয়। ওটা আসলে ৩৮ শতাংশ, আর অন্যান্য খাতে ১৩ শতাংশ নয় আসলে ৩৩ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া মোট টাকার ৩৬ শতাংশ শেষ করা গিয়েছে।”
এই চাপান-উতোর নিয়ে দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, “তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়াও হয় খরচের পরিমাণ ৩৬ শতাংশ, তা হলে সেটাও তো অনেক কম। কারণ এত দিনে অন্তত ৫০ শতাংশ অর্থ খরচ করে ফেলার কথা।”
এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিবের যুক্তি, গত আর্থিক বছরের টাকা কেন্দ্র দেরি করে পাঠিয়েছিল। সেটা খরচে সময় লেগেছে। তাঁর দাবি, “আমরা আমাদের কাজ ভাল ভাবে করছি। এটা জনগণের টাকা।
এর খরচ নিয়ে কারও হুমকি বরদাস্ত করা হবে না।” |