ঝুমুরের মেঠো সুর ফিরে এসেছে তালড্যাংরার বিবরদা গ্রামে। রাত গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুমুরের মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন শ্রোতারা। যেমনটা হত কয়েক দশক আগে।
এ গ্রামেই জন্মেছিলেন প্রখ্যাত ঝুমুর শিল্পী মতিলাল লায়েক, বাঁকু লায়েক ও ঝুমুর পদকর্তা জ্যোতি সামন্ত। তাঁদের সুরে, তাঁদের গানে তখন মেতে থাকত বিবরদা তো বটেই, তাবড় রাঢ় বাংলা। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর পর কয়েক দশকে উত্তরাধিকার তৈরি হয়নি। তাই এই এলাকায় ফিকে হয়ে যাচ্ছিল ঝুমুর। সেই লোক-সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে এনে ওই তিন শিল্পীকে সম্মান জানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন গ্রামেরই কিছু বাসিন্দা। তাঁরাই শুরু করেছেন ‘ব্রাত্যজনের গানের মেলা’। মঙ্গলবার শুরু হয়েছে ৯ দিনের ওই উৎসব। বাস্তবিক ওই এলাকায় উৎসবের মেজাজ।
বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার বিভিন্ন গাঁ-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা ২৮ জন ঝুমুর শিল্পী এখানে এসেছেন। |
এমন নাচেই মজল দর্শক। ছবি: শুভ্র মিত্র। |
তাঁদের মধ্যে অনেকই নাচনি। বাঘমুণ্ডির নাচনি সরস্বতী সিং পাতর, আড়শার বিমলা কুমার বলেন, “এক সময় গ্রামে-শহরে ঘুরে ঘুরে আমরা নেচে-গেয়ে বেড়াতাম। কী যে হল, এখন আর লোকে ডাকেই না। অথচ তখন আমাদের কত সম্মান ছিল। কত মানি-গুণী লোক আমাদের খাতির করেছেন।” সে দিন হয়ত ফিরবে না। কিন্তু ঝুমুর শিল্প যাতে হারিয়ে না যায়, সেই চেষ্টাই করছেন উদ্যোক্তারা।
মেলা কমিটির আহ্বায়ক দুর্গা দত্ত বলেন, “লোকায়ত সংস্কৃতি ঝুমুরের বিলীয়মান ধারাটিকে এখনও অনেক কষ্টে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা হলেন নাচনি। এক সময় এই অঞ্চলের রাজ দরবারে বা সামন্তদের বৈঠকখানায় তাঁদের কদর ছিল। সিন্ধুবালাদেবীর মতো ঝুমুরশিল্পীদের সরকার থেকে লালন পুরস্কার দেয়। কিন্তু সমাজ-অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে অনেক বদল এসেছে। তবুও শ্রোতা-দর্শকদের মাতিয়েও গ্রামসমাজে তেমন সম্মান পান না ওঁরা।” এই ক’দিনের সমস্ত অনুষ্ঠান ভিডিও রেকর্ডিং করে রাখা হচ্ছে। লুপ্তপ্রায় এই শিল্পকে সংরক্ষণ করাই তাঁদের লক্ষ্য।
গ্রামের হাইস্কুলের মাঠে মঞ্চ বেঁধে গান মেলা শুরু হয়েছে। বিকেল থেকেই সেখানে গ্রামবাসীদের ভিড়। শুকদেব বিদ, শশাঙ্ক মণ্ডলরা বলেন, “এই গ্রামে একসময় ঝুমুর গানের চল ছিল। মতিলাল লায়েক, বাঁকু লায়েকের মতো নামী ঝুমুর শিল্পীরা এলাকা মাতিয়ে রাখতেন। তাঁদের স্মরণে এমন একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখে ভাল লাগছে।”
মেলায় দেখা হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক-সংস্কৃতি গবেষক খেয়া সমাদ্দারের সঙ্গে। তাঁর আক্ষেপ, “ঝুমুর তো প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। এখানে এসে তাই সত্যিই ভাল লাগছে।” এসেছেন খাতড়ার তরুণী চৈতি মণ্ডল, দুর্গাপুরের অঞ্জনা দত্তরা। তাঁরাও দেখি ঝুমুরের গানে বুঁদ। মঞ্চে তখন সরস্বতীদেবী ও বিমলাদেবীর সঙ্গে রসিক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় ও বাদ্যযন্ত্রীরা গান ধরেছেন ‘প্রেম জানে রসিক জনে/ অন্যে কী জানে ভাইগো...’। |