সৌরাষ্ট্রের সংসারে দেখতে দেখতে দশটা বছর কেটে গেল। আমি প্রথম যখন ওখানে যাই, প্রায় কেউ চিনতই না টিমটাকে। রঞ্জির প্লেটে খেলত। আর আজ আমার টিম রঞ্জি ফাইনাল খেলছে। মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে। আশ্চর্য শোনাচ্ছে না?
নিজে আমি এতটুকু আশ্চর্য নই। যে দিন বাংলা ছেড়েছিলাম, জানতাম প্রবল খাটুনিটা যদি চালিয়ে যেতে পারি, ঈশ্বর আমাকে নিরাশ করবেন না। আর সে জন্যই ভেতরে ভেতরে একটা বিশ্বাস জন্মেছে যে, এত যুদ্ধের পর যখন রঞ্জি ফাইনালে উঠেছি ট্রফিটা নিয়েই ফিরব। অনেককেই বলতে শুনছি, আমার হাতে চেতেশ্বর পূজারা নেই। রবীন্দ্র জাডেজা নেই। সচিন তেন্ডুলকরের মুম্বইয়ের সঙ্গে কী নিয়ে লড়ব?
সবিনয়ে তাঁদের একটা কথা বলে রাখি। রঞ্জি সেমিফাইনালে আমরা যে পঞ্জাবকে হারিয়েছি, সেখানে আমার টিমলিস্টে কিন্তু কোনও রবীন্দ্র জাডেজা কিংবা চেতেশ্বর পূজারার নাম ছিল না। আর পঞ্জাব এ বারের রঞ্জিতে কী করেছে না করেছে, একটু স্ট্যাটিসটিক্স খুলে দেখে নিন। গ্রুপে ওদের পারফরম্যান্সে সবারই তো বুকে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল! আসলে আমার কে আছে, কাকে পাব, ও সব আমি দেখি না। এই যে ধর্মেন্দ্র জাডেজাকে নিয়ে এত হইচই, ওকে আমি কত দিনে তৈরি করেছি জানেন? সাত দিন, ঠিক আছে? অনূর্ধ্ব-২৫ থেকে তুলে এনেছিলাম। আমার তখন বাঁ-হাতি স্পিনার দরকার। রবীন্দ্র জাডেজা নেই। ধর্মেন্দ্র এসে বলল, স্যর মেরা বল ঘুমতা নহি হ্যায়। ডেকে বুঝিয়ে দিলাম, কী ভাবে ঘোরাতে হবে। |
আসলে কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় থাকলে জীবনে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। যেটা আমার জীবনের প্রিন্সিপাল। বিপক্ষে কে আছে, তা নিয়ে আমি অহেতুক আতঙ্কে ভুগি না। বোর্ড কেন রঞ্জি ফাইনাল পিছোল না, তা নিয়ে অভিযোগ তুলে অজুহাত খুঁজি না। সচিন এ বার বহু দিন পর রঞ্জি ফাইনাল খেলছে। স্বাভাবিক ধারণা হল, বোলার উল্টো দিকে ওকে দেখলে ঘাবড়ে যাবে। চাপে পড়বে। কিন্তু সচিনকে ভীতি হিসেবে নয়, মোটিভেশন হিসেবে ব্যবহার করব। ফাইনালের সকালে ড্রেসিংরুমে বোলারদের বলব: জীবনে যদি বড় হতে চাও, এই উইকেটটা নিয়ে দেখাও।
দেখুন, নামটা সচিন তেন্ডুলকর যখন, স্ট্র্যাটেজি করে বিশেষ লাভ নেই। ইদানীং ও ইনকামিং ডেলিভারিতে বেশি আউট হচ্ছে বলে সেটাকেই ওষুধ হিসেবে লাগাতার ব্যবহারের পরামর্শেরও কোনও যুক্তি নেই। সচিন যে দিন খেলবে, যে কোনও স্ট্র্যাটেজির বারোটা বাজিয়ে দেবে। কিন্তু বাড়তি ভয় পেয়েও কোনও লাভ নেই। আমাদের জেতালে এরাই জেতাবে।
আর সৌরাষ্ট্র ক্রিকেটের এমন উন্নতির পিছনে আমার যদি কৃতিত্ব থাকে, তা হলে নিরঞ্জন শাহেরও আছে। ’৯৭-এ বাংলার কোচিং যে দিন ছাড়লাম, সে দিন থেকে নিরঞ্জন আমার পিছনে পড়ে গিয়েছিল। হয়তো দিলীপ দোশীর থেকে শুনে থাকবে আমার কথা। বলতে গেলে, নিমরাজি হয়ে এসেছিলাম। আর ছ’মাস পেরোতে না পেরোতেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, এখানে আমার কিছু করা সম্ভব নয়। কেউ প্রায় কিছুই জানে না। পরিকাঠামো নেই। আমার স্ত্রী রাখি তখন বোঝায়। ওর বোঝানোতেই ফের ফিরে আসি।
নিরঞ্জন আমাকে সেই সময় অসম্ভব সাহায্য করেছে। প্লেয়ার তুলতে আমি তখন অনূর্ধ্ব-২৫, অনূর্ধ্ব-১৯ দেখে বেড়াতাম। ছেলেগুলোকে ক্রিকেটের বেসিক্স শেখাতাম। আজও সেটাই করি। আমার হাতে এখনও গোনাগুনতি তিরিশটা প্লেয়ার। যাদের মধ্যে পনেরোজন রঞ্জি খেলে। বাকিদের এখনও বেসিক্স শেখাচ্ছি। সেলডন জ্যাকসন ম্যাচের পর ম্যাচে রান করছে এখন। ওকে আমি হোটেলের ছাদে শ্যাডো করিয়েছি রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ব্যাটিং শেখাতে। রবীন্দ্র জাডেজা গত অগস্টে এসে বলল, ও টেস্ট খেলতে চায়। সোজা বললাম, তা হলে লিফট মারাটা বন্ধ করো। নেটে সেটাই প্র্যাকটিস করো। গত রঞ্জিতেই বাংলার বিরুদ্ধে ম্যাচে জাডেজার ধৈর্য দেখে বাংলা ম্যানেজার অবাক। শুনে বললাম, এক দিনে এ সব হয় না। চেষ্টা করো, তোমাদেরও হবে।
সে জন্যই বাংলার ওপর আমার বিশেষ কোনও রাগ নেই। কেন হবে? বাংলাই আমাকে দেবু মিত্র বানিয়েছে। ক্রিকেটার ছিলাম। কোচ ছিলাম, নির্বাচক ছিলাম। তার পর সৌরাষ্ট্রে এসেছি, খেটেছি। বিশ্বাস করি, পরিশ্রম করলে যে কেউ তার মর্যাদা পাবে। যেমন আজ আমি পাচ্ছি।
রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হলেও মনে করব, দশ বছরের পরিশ্রমেরই মর্যাদা পেলাম। বাংলার বিরুদ্ধে জিতলাম না! |