কংগ্রেসে সহ-সভাপতি হওয়ার পর রাহুল গাঁধীর ভাষণ শুনে অনেকেই বলছেন এমন আবেগময় ভাষণ সাম্প্রতিক কালে কোনও কংগ্রেস নেতার কাছ থেকে শোনা যায়নি। যেন ভারতের বারাক ওবামা! কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন চাইছেন। মহাত্মা গাঁধীর কথা বলছেন। ক্ষমতাকে তুলনা করছেন ‘বিষ’-এর সঙ্গে। সব মিলিয়ে যেন অনেকখানি নিজের মতো। স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য রচনা কতটা আন্তরিক, আর কতটা কংগ্রেসের প্রাক্-নির্বাচনী ভাবমূর্তি গঠনের স্বার্থে, সেই বিতর্কেও আমরা যেতে চাই না। এ কথা সত্য যে, বর্তমান পরিসরে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটা ঝাঁকুনি প্রয়োজন ছিল। ক্রমাগত নানা অভিযোগ আর সামাজিক আন্দোলনের আক্রমণে বিপর্যস্ত ইউ পি এ সরকারের ঘরে-বাইরে অস্বস্তি কাটাতে প্রধান শরিকের পাবলিক ইমেজ-এ একটা পরিবর্তন আসা জরুরি। এত গভীর আবেগ কিছুটা এই জন্যই।
কিন্তু, অন্তত বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে, সেটাই সব নয়। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ‘রাজনীতি শুধু আবেগ দিয়ে হয় না।’ রাজনীতি তবে কী দিয়ে হয়? নেতা সর্বদা কী কী বলবেন? প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভাষাই প্রধান হবে? আত্মসমালোচনা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে আমরা প্রতিপক্ষকে চমকানো-ধমকানোর রাজনীতিতেই অভ্যস্ত। তাই কোনও নেতা অন্য রকম কিছু বললেই তাঁর ‘গূঢ় উদ্দেশ্য’ নিয়ে জল্পনা করতে হয়, বা নেহাতই উড়িয়ে দিতে হয়। বিশেষ করে আমরা তো জানিই, আবেগ মেয়েলি ব্যাপার, পুরুষদের কান্নাকাটি করা একদম সাজে না! আমাদের পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতিতে ইন্দিরা গাঁধী আদর্শ। রাহুলের বক্তৃতা আবেগসর্বস্ব, প্যানপেনে।
|
কাছে। কোকরাঝাড়ে দাঙ্গার পরে। সেপ্টেম্বর ’১১। ছবি: উজ্জ্বল দেব |
রাহুল গাঁধী শুধু আবেগের কথা বলেননি, কিছু গুরুত্বপূর্ণ দাবির কথাও বলেছেন। গণতন্ত্রে যে স্তরে আমরা আছি, তা থেকে কিঞ্চিৎ উত্তরণ ঘটাতে গেলে নবজাগ্রত নানান সামাজিক চাহিদার স্বীকৃতি আবশ্যিক, রাজনীতির পরিসরে সেই সব চাহিদার প্রবেশ আবশ্যিক। আবার, পুরনো অনেক রাজনৈতিক দাবি হয়তো আর তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। সেটাও খেয়াল করা জরুরি। যে দেশে প্রায় মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার সঙ্গে আধুনিক মননের দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত চলছে, সেখানে রাজনীতি যদি সেই দ্বন্দ্বকে স্বীকার না করে, তবে রাজনীতি সামাজিক প্রেক্ষিতকে ধরতে পারবে না , ফলে নিজে বিপন্ন হয়ে পড়বে, এমন আশঙ্কা প্রবল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তেমনই ইঙ্গিত দেয়। নবজাগ্রত অধিকারসমৃদ্ধ নাগরিক চেতনা বিক্ষিপ্ত হতে পারে, কিন্তু তা দলীয় প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ নয়। তার প্রতি ক্রমাগত অবহেলা সামাজিক জীবনকে গভীর নৈরাজ্য ও প্রায় গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।
এই প্রেক্ষিতেই রাহুল বলেন, ‘আমাদের যুব সম্প্রদায় এত রেগে গিয়েছে কেন... তারা পথে নেমেছে কেন... তারা ক্রুদ্ধ কারণ তারা বিচ্ছিন্ন... তারা রাজনৈতিক নেতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা রাস্তার ধার থেকে দেখে, লাল বাতি জ্বালিয়ে ক্ষমতাবানরা চলে যাচ্ছেন...’ (আ বা প, ২১-১)। শুনলে মনে হয়, নাগরিক জীবনের অস্থিরতাকে তিনি নিজের মতো করে বুঝতে চাইছেন। নাগরিক অধিকারসমৃদ্ধ এক রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা করছেন। ভাবতে ভাল লাগে, তিনি লিঙ্গবৈষম্যকে রাজনৈতিক প্রতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চাইছেন। জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যাগুলিকে রাজনীতির মঞ্চ থেকে চিহ্নিত করছেন। এর সঙ্গে মেলে না জলকামান, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ইত্যাদি। তাঁর বক্তৃতা অন্য ধরনের রাজনীতির ইঙ্গিত দেয়।
কিন্তু তার বাস্তবায়নের কোনও দিশা দেখায় না। ক্ষমতাকে বিষ বলা হয়। অথচ সেই বিষের প্রয়োগ কোথায় কোথায় হয়েছে, তাকে চিহ্নিত করে না। লাঠি, জলকামান, কাঁদানে গ্যাসের অপপ্রয়োগের নিন্দা করে না। সামগ্রিক ভাবে একটা বিকল্প রাজনীতির বাস্তবায়নের পদ্ধতির উদ্ভাবন করে না। রাষ্ট্রের প্রচলিত পদ্ধতিকে প্রশ্ন না করে, তার নিষ্ঠুরতাকে নিন্দা বা অপদার্থতাকে বিদ্ধ না করে শুধুমাত্র কিছু প্রসাধনিক পরিবর্তনের কথায় রাজনীতির ‘র’ও পাল্টাবে না। বরঞ্চ এই আশঙ্কা আবার মাথাচাড়া দেয় যে, সামাজিক আন্দোলনের মোকাবিলার জন্য রাহুল গাঁধী কি কংগ্রেসের সেফ্টি ভালভ? তাঁর এই বক্তব্যগুলির বিপণন কি সামাজিক চাপে উদ্ভ্রান্ত ইউ পি এ-র অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল না? সরকারের মৌলিক নীতির পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র পদ্ধতিটা একটু পরিবর্তন করা যাক, এই যা।
আশঙ্কা আরও দৃঢ় হয় কংগ্রেস দল নিয়ে রাহুলের প্রবল আশাবাদে। নিজের দল নিয়ে আবেগ স্বাভাবিক। কিন্তু তা যখন বাস্তবতারহিত হয়ে পড়ে তখনই সমস্যা। কংগ্রেসের একলা চলার বাসনা বহু দিনের। কিন্তু আজকে তা সম্ভব নয়, উচিতও নয়। জোট রাজনীতিই আজকের বাস্তবতা। কংগ্রেস-এর যুবরাজ সে বিষয়টি নিয়ে কোনও চর্চাই করলেন না। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কী ভাবে তাঁর দল পরিচালিত হবে, সে বিষয়েও তাঁর অবস্থান কোনও গভীর চিন্তার পরিচয় দেয় না। কেন্দ্রীয় স্তরে চল্লিশ-পঞ্চাশ এবং রাজ্য স্তরে দশ জন মতো নেতা তৈরি হলেই দল চলবে? এঁরাই মন্ত্রী-সান্ত্রি হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন? নেতা তৈরির বিচিত্র পদ্ধতি! সমস্যা হল, রাজনৈতিক দল তো ম্যানেজমেন্ট স্কুল নয়, যে কিছু ঝাঁ চকচকে ব্যক্তি এসেই সবটা পাল্টে দেবেন। তদুপরি ভারতের মতো বৈচিত্রময় দেশে প্রতিটি রাজ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতা আলাদা। সেই বাস্তবতার সাপেক্ষে দলকে চলতে গেলে কেন্দ্রীভূত কোনও স্থির পদ্ধতির অনুকরণ করলে হবে না। বরঞ্চ সে ক্ষেত্রে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আশ্রয় তিনি নিতে চাইছেন, সেটাই পরাস্ত হবে। এমন এক কেন্দ্রীকৃত ভাবনার অত্যাচার শুরু হবে, যা তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণেও থাকবে না। যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্বপ্ন তিনি দেখাচ্ছেন, প্রদেশ স্তরের নেতাদের স্বাধীন চিন্তা অনুযায়ী চলতে না দিলে তা অধরাই থেকে যাবে।
অর্থাৎ, রাহুলের সামগ্রিক বক্তব্যে তাঁর যে রাজনৈতিক মানসের চিত্র উঠে এসেছে, তা এক দিকে অসম্পূর্ণ এবং কাঠামোবর্জিত, অন্য দিকে অপরিপক্ব। এটা চিন্তার বিষয়।
কংগ্রেস দলে তাঁর অভিষেক সেই দলের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু তাঁকে যদি ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হয় তবে তাঁর চিন্তার ফসল আমাদের ভোগ করতেই হবে। আশেপাশে এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে যেখানে আমরা শাসকের বক্তব্য বা চিন্তাধারার নিয়ত সমালোচনা করে চলেছি বা করতে বাধ্য হচ্ছি। রাহুল গাঁধীকে যেন এমন কিছু করতে না হয়। ‘পরিবর্তন’ ভাল, তবে একটু ধীরে, ভেবেচিন্তে।
|
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |