|
|
|
|
সাক্ষাৎকার ... |
এত দিন তো গরিব মানুষের টাকা দালালরা
নয়ছয় করছিল, তার চেয়ে গরিবরাই করুক
সরাসরি গরিবের হাতে টাকা দেওয়ার নীতি চালু করছে কেন্দ্রীয় সরকার। এতে চোখের পলকে সব
সমস্যা মিটে যাবে না, কিন্তু ‘আমরা এত দিন অবধি যে ভাবে ভর্তুকি দিয়ে এসেছি, এটা তার চেয়ে অনেক ভাল।’
সম্প্রতি কলকাতায় এক একান্ত কথোপকথনে জানিয়েছেন ভারত সরকারের ভূতপূর্ব অর্থনৈতিক
উপদেষ্টা এবং বর্তমানে বিশ্বব্যাঙ্কের চিফ ইকনমিস্ট
কৌশিক বসু |
কেন্দ্রীয় সরকার তথা কংগ্রেস ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার আরম্ভ করছে বটে, কিন্তু সেটা কি অর্থনীতির যুক্তির কথা ভেবে? না কি ২০১৪ মাথায় রেখে? এটা কি মানুষকে এক ধরনের লোভ দেখানো নয়, যে আমাদের ফের জিতিয়ে আনলে আমরা তোমাদের অ্যাকাউন্টে আরও টাকা দেব? পুরো গল্পটাই তো রাজনীতির?
এই কথাটা আমাকে অনেকেই বলছে, যে এটা ‘গুড পলিটিকস’। সত্যি বলতে, আমি রাজনীতি তত ভাল বুঝি না। কিন্তু আমার মত হল, এটা গুড ইকনমিকস। কাজেই রাজনীতির কথা ভেবেও যদি সরকার এই প্রকল্পটাকে ঠিকঠাক চালু করে, সেটা একটা ভাল কাজ হবে। আমাদের দেশের নিয়মই হল, মানুষকে ভর্তুকি দিতে চাইলে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। তাতে বাজারের কুশলতার ভয়ানক ক্ষতি হয়। অপচয়ের পরিমাণ বাড়ে। এই ভর্তুকি যাদের পাওয়ার কথা নয়, সেই বড়লোকরা কম দামের সুবিধা নেয়। এ বার যদি সরাসরি গরিবের হাতে টাকা দিয়ে দেওয়া যায়, তবে দাম কমাতে হল না, যাদের ভর্তুকি পাওয়ার কথা নয় তাদের বাদ রাখা গেল... আমরা এত দিন অবধি যে ভাবে ভর্তুকি দিয়ে এসেছি, এটা তার চেয়ে অনেক ভাল। বলছি না যে সম্পূর্ণ দুর্নীতি দূর করা যাবে এখনও কিছু টাকা নয়ছয় হবে। কিন্তু সেগুলো সামলাতে হবে।
চাল-ডালের বদলে হাতে টাকা তুলে দিলে গরিব মানুষ সে টাকা ভুল কাজে খরচ করবে না, সেটা নিশ্চিত করা যাবে?
সে সম্ভাবনা আছে। কিন্তু গরিব মানুষ নিজের ভাল কিছুই বোঝে না, তার ভাল চাইলে তার ঘরের দোরগোড়ায় খাবার, পুষ্টি পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে এটা মেনে নিতে আমি রাজি নই। আর, এত দিন তো গরিব মানুষের টাকা দালালরা নয়ছয় করছিল। তার চেয়ে গরিবরাই করুক! এই সমস্যাটা অনেক দূর অবধি এড়ানো যায়। বাড়ির পুরুষদের বদলে মহিলাদের হাতে টাকা এলে একই পরিমাণ টাকার অনেক ভাল ব্যবহার হয়। কেরল, কর্নাটকে এটা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে অনেক দিন আগেই। ভারতেও যত দূর সম্ভব মেয়েদের হাতেই টাকা তুলে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ব্রাজিলের অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে হাতে টাকা দেওয়ার বদলে যদি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া হয়, তাতেও সেই টাকার অপচয় কমে। টাকা না দিয়ে স্মার্ট কার্ডও দেওয়া যেতে পারে যেটা শুধু খাবারের দোকানেই কাজ করবে, মদের দোকানে নয়। আমাদের গণবণ্টন ব্যবস্থায় ৪০ শতাংশেরও বেশি পণ্য মাঝপথেই চুরি হয়ে যাচ্ছে, পচে নষ্ট হচ্ছে। সরকার কেরোসিনে ভর্তুকি দিয়ে কম দামে বিক্রি করছে, আর সেই কেরোসিন সীমান্ত পার হয়ে নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশে তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।
|
সরাসরি। মহারাষ্ট্রে সুযোগ হস্তান্তর প্রকল্প উদ্বোধন করছেন মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চহ্বাণ। ছবি: পি টি আই |
ব্রাজিলে তো ক্যাশ ট্রান্সফার শর্তসাপেক্ষ। ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে অথবা তাদের টিকা দিয়ে সেই কাগজ জমা করলে তবেই সরকার ক্যাশ ট্রান্সফার করবে। ভারতে সে ব্যবস্থা নেই। তা হলে ব্রাজিলের পথে চলেই ভারতেও এই ব্যবস্থা সফল হবে, নিশ্চিত করে বলা যাবে কি?
ঠিকই, শর্তসাপেক্ষে টাকা দেওয়াটাই সেরা। তাতে উন্নয়ন দ্রুত হয়। কিন্তু ভারতে এই ব্যবস্থা চালু হলেই হয়তো আর একটা দুর্নীতির চক্র তৈরি হয়ে যাবে নকল স্কুল সার্টিফিকেট, নকল টিকার কাগজ তৈরি হবে! তাই আপাতত শর্তহীন ক্যাশ ট্রান্সফারই ভাল। পরে শর্তসাপেক্ষ ব্যবস্থার দিকে যাওয়া যাবে।
ভারতের গ্রামাঞ্চলে এখনও তেমন ব্যাঙ্ক নেটওয়ার্ক তৈরি হয়নি। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশও নিজে ব্যাঙ্কের কাগজপত্র ভ’রে টাকা তুলতে পারেন না। এই অবস্থায় ভর্তুকির টাকাটা যদি ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই দেওয়া হয়, তবে কি আসলে সরকার এই টাকা হাতে পাওয়ার কাজটাকেই খুব কঠিন করে দিচ্ছে না?
এখনকার ব্যবস্থাটা কী, ভেবে দেখো। মানুষ দেখছে এফসিআই থেকে রেশন দোকানে চাল-গম আসছে। কিন্তু তুলতে গেলে দোকানদার বলছে, আসেনি। সেই চাল-গমই পাশের দোকানে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। খাবারে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। এগুলো নেহাত আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে বলে! কিন্তু এই অবস্থা বদলানো দরকার। এখন যদি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা দিয়ে সরকার বলে, যাও বাজার থেকে চাল-গম কিনে নাও সেটায় মানুষের খুশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এটা ঠিক যে আমাদের দেশে এখনও বহু মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। ফলে এখনই এই প্রকল্প তুমুল সফল হবে, সে কথা বলছি না। কিন্তু অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির কাজ আরম্ভ হয়েছে। প্রণববাবুর আমলেই স্বাভিমান বলে একটা প্রকল্প তৈরি হয়েছিল। ব্যবস্থাটা চালু হোক, আমার ধারণা টাকা পেতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। খুব বেশি সময়ও লাগবে না। আমাদের দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রটি কিন্তু উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে টক্কর নেওয়ার মতো। ফলে ব্যাঙ্কিং ছড়িয়ে পড়বেই। তার সঙ্গে সঙ্গে ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের কাজও এগোবে। কিন্তু এই সব বাধার কথা ভেবে ক্যাশ ট্রান্সফার আটকে রাখার প্রশ্নই ওঠে না।
আধার-এর বায়োমেট্রিক তথ্যের ক্ষেত্রে বহু সমস্যা হচ্ছে। আঙুলের ছাপ মিলছে না। এই অবস্থায় বায়োমেট্রিক তথ্য-নির্ভর একটা ব্যবস্থার হাতে এত বড় প্রকল্প ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে কি?
দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশেই ব্যাঙ্কিং বায়োমেট্রিক তথ্য-নির্ভর নয়। সইয়ের মাধ্যমেই কাজ চলে, বড়জোর কিছু পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হয়। বায়োমেট্রিক তথ্য-নির্ভর ব্যাঙ্কিং আমরাই আরম্ভ করছি। যদি সফল হয় তবে এটা গোটা দুনিয়ায় ভারতের অবদান হবে। যদি সফল না হয়, আর পাঁচটা দেশে যে ভাবে ব্যাঙ্কিং চলে, এখন ভারতে যে ভাবে ব্যাঙ্কিং চলছে, ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার সে ভাবেই হবে। তবে বায়োমেট্রিক তথ্যের ব্যবহার ক্রমে বাড়বে। বহু দেশে ভিসার ক্ষেত্রে এই তথ্য ব্যবহৃত হয়। দু’হাতের দশ আঙুলের ছাপ, রেটিনা সব মিলিয়ে তথ্যভাণ্ডার তৈরি হয়। তার পর স্ট্যাটিস্টিকালি দেখা হয়, ধরো মোটামুটি ৯৫% মিললেই কাজ চলে।
প্রকল্পটি ঘোষিত হল নভেম্বরের শেষে। আর জানুয়ারির এক তারিখ থেকে ২০টা জেলায় পুরোপুরি চালু হয়ে গেল। এত তাড়া কীসের? ভোটের?
এটা আমি সত্যিই জানি না। এখন আর এত খুঁটিয়ে খোঁজ রাখি না, ফলে বলতে পারব না প্রয়োজনের চেয়ে বেশি হুড়োহুড়ি হচ্ছে কি না। তবে নন্দন নিলেকানি আছেন। তাঁর টিম আছে। সরকার ম্যানেজ করতে পারবে বলেই মনে হয়। তবে ভোটের তাড়া থাকা খারাপ নয়। সরকার অনেক বেশি খাটবে এই সময় প্রকল্পটাকে ভাল ভাবে চালু করতে চাইবে।
নন্দন নিলেকানি খুব উঁচু দরের টেকনোক্র্যাট। কিন্তু আধার-এর মতো প্রকল্প চালু করতে গিয়ে একেবারে তৃণমূল স্তরে যে সমস্যা হচ্ছে, সেটা বোঝার মতো অভিজ্ঞতা কি তাঁর আছে? মনে হয় না, এক জন টেকনোক্র্যাটের হাতে এই প্রকল্পের ভার পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া মানেই আম-আদমির অসুবিধাগুলোকে পাত্তা না দেওয়ার নামান্তর?
ঠিকই, নন্দনের মাটির কাছাকাছি কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। আসলে, যার যেটা আছে, সেটাকে ঠিক করে ব্যবহার করতে হবে। নন্দন নিজে অসম্ভব দক্ষ। আমি ওর টিমের সঙ্গে কাজ করেছি অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা চমৎকার কাজ করছে, রাজনীতিকদের মতো কে বড় কে ছোট, সেই হিসেব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। নন্দনকে সরিয়ে দিলে চলবে না, কিন্তু মাঠেঘাটে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, এমন কাউকে নন্দনের সঙ্গে কাজ করতে দিতে হবে। জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদে তেমন লোক কিন্তু আছে।
তা হলে আপনি সম্পূর্ণত ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের পক্ষে?
অনেকগুলো সমস্যা আছে, কিন্তু সেগুলো ঠিক করা খুবই সম্ভব। একটা অন্য কথা বলি। ইউ পি এ সরকার গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনায় অনেক খরচ করেছে। তাতে গ্রামে মজুরির হার বেড়েছে, যা আমি খুবই ভাল বলে মনে করি। কিন্তু যত টাকা খরচ হয়েছে, উৎপাদনশীলতা তত বাড়েনি। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাতের গ্রামে দেখেছি, কর্মসংস্থান প্রকল্পে খুব ধীরে কাজ এগোয়। টাকা ঢালা হচ্ছে, কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে না মূল্যস্ফীতি হবেই। এ দিকে, কর্মসংস্থান প্রকল্পে কাজ পাওয়া মানে সেখানে কাজ করুক আর না-ই করুক, শ্রমিক আটকে গেল। ফলে অন্য কাজে শ্রমিকের অভাব ঘটে। তাতেও উৎপাদনশীলতা কমে। ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারে সরকার টাকা যা দেওয়ার দেবে, কিন্তু শ্রমিক অন্য কাজ করতে পারবে। দেশের উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় ফারাক। এই ফারাকটা বোঝা দরকার। এ দিক থেকে দেখলেও ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফার খুব জরুরি একটা প্রকল্প।
|
সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত |
|
|
|
|
|