প্রধানত মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল রোগীদের সেবা বা ‘নার্সিং’-এর পেশাটি। এ বার সরকারি হাসপাতালে পুরুষ নার্স নিয়োগ করিবার ইচ্ছা দেখাইয়াছে স্বাস্থ্য দফতর। নীতিগত ভাবে ইহাতে আপত্তি নাই। সংরক্ষণের কোনও বিশেষ কারণ না থাকিলে কোনও বিশেষ লিঙ্গ কিংবা জাতির জন্য কোনও পেশাকে সংরক্ষিত করা সমর্থনযোগ্য নহে। পুরুষদেরও অধিকার রহিয়াছে রোগীর সেবা করিবার। কেবল নার্সিং নহে, গোটা বিশ্বে পরিচর্যা-শিল্প বা ‘কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি’ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে, সেখানে কাজের সুযোগ বাড়িতেছে। পরিচর্যা-পরিষেবার সামাজিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ, তাই সেখানে পুরুষের যোগদানকে স্বাগত জানাইতে হয়। আপত্তি অন্য জায়গায়। প্রয়োজনের তুলনায় কম মহিলা নার্সিং-এর কাজে আসিতেছেন বলিয়া পুরুষদের সেই কাজে লইবার কথা চিন্তা করা হইতেছে। ইহা সমস্যাকে না বুঝিয়া চটজলদি সমাধান খুঁজিবার চেষ্টামাত্র। এমনকী, সমস্যার প্রকৃতিকে না বুঝিয়া, তাহার বিকৃত ব্যাখ্যা করা হইতেছে। মহিলাদের মাতৃত্বের ছুটিকেই নার্স অমিল হইবার কারণ বলিয়া দেখাইবার একটি প্রচেষ্টা চলিতেছে। দেশ জুড়িয়া প্রায় ছয় লক্ষ নার্সের ঘাটতি রহিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গে ঘাটতি অন্তত চার হাজার। তাহা কি পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতে মহিলাদের কাজের চাহিদা কিংবা উদ্যোগের অভাবে? না কি তাহা শিক্ষার যথাযথ পরিকাঠামোর অভাবে? এ রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ২০ শতাংশ স্কুলেও বিজ্ঞান পড়িবার সুযোগ নাই। যদি কেবল বালিকা বিদ্যালয়গুলি ধরা হয়, তাহা হইলে সেই অনুপাত ১০-১২ শতাংশও ছাড়াইবে না। তাহা হইলে নার্সিং পড়িবার যোগ্যতা কী রূপে অর্জন করিবে মেয়েরা? গোড়ায় গলদের দায় মেয়েদের লইতে হইবে কেন?
এক দিকে বহু সংখ্যক মেয়ে নার্সিং করিতে ইচ্ছুক হইয়াও অপারগ। অন্য দিকে এই পেশাটি বহু মেয়ের কাছে আকর্ষণীয় নহে। এক সময়ে শিক্ষকতা এবং নার্সিং ব্যতীত মেয়েদের নিকট কোনও পেশা সুলভ ছিল না। এখন কাজের অনেক সুযোগ খুলিয়া গিয়াছে। কেন নার্সিং-এ মেয়েরা উৎসাহী হইবে? কেনই বা অভিভাবক তাহাদের উৎসাহ দিবেন? পদোন্নতি এবং স্বীকৃতির কতটুকু সুযোগ? হাসপাতালে বা স্বাস্থ্য প্রশাসনে নার্সদের সম্মান বা স্বীকৃতি কতখানি? স্বাস্থ্যনীতি বিষয়ে, শিশুমৃত্যুর প্রতিরোধে, জননীমৃত্যু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে নার্সের পরামর্শ কে শুনিতে চায়? কতিপয় চিকিৎসকই বরাবর ‘বিশেষজ্ঞ’ বলিয়া স্বীকৃতি পাইয়াছেন। নার্স সেখানে ‘স্নেহময়ী সিস্টার’ রূপে ওয়ার্ডেই সীমাবদ্ধ। সমাজে কিংবা প্রশাসনে তাঁহার কোনও স্বীকৃতি নাই। অন্য দেশে কিন্তু ব্যবস্থা অন্য রকম। সেখানে অভিজ্ঞ নার্সরা শিশুস্বাস্থ্য-সহ জনস্বাস্থ্যের নানা বিষয়ে চিকিৎসকদের অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব পাইয়া থাকেন। স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ে তাঁহাদের স্থান নেতৃত্বের। এ দেশে চিকিৎসকদের সংগঠন চিকিৎসার বিষয়ে নার্সদের সামান্যতম দায়িত্ববৃদ্ধিকে রুখিয়া দিয়াছে বারবার। পুরুষ নার্স নিয়োগে এই অবমাননা হইতে নার্সিং পরিষেবা মুক্তি পাইবে কি? |