|
|
|
|
ধর্ষণে প্রাণদণ্ডের সুপারিশ নেই বর্মা কমিশনের রিপোর্টে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনার পরে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়ে সরব হয়েছিল সমাজের বিভিন্ন অংশ। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে এস বর্মার নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্ট কিন্তু ধর্ষণের অপরাধে ফাঁসির সুপারিশ করল না। সেটা ‘পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ’ হবে বলে মত দিয়েছে কমিটি। একই ভাবে লিঙ্গচ্ছেদও কোনও শাস্তির মডেল হতে পারে না। কারণ, ভারতীয় সংবিধান কারও অঙ্গছেদনের অনুমতি দেয় না বলে কমিটি জানিয়েছে। তাঁদের মতে, এ সবের পরিবর্তে প্রশাসন আরও সক্রিয় হলেই অপরাধ কমানো যাবে।
প্রবল নাগরিক আন্দোলনের মুখেই প্রচলিত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত আইন ও দণ্ডবিধি সংশোধনের কার্যকারিতা খতিয়ে দেখতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জে এস বর্মার নেতৃত্বে তিন জনের কমিটি করেছিল কেন্দ্র। ২৯ দিনের মাথায় আজ রিপোর্ট জমা দিল কমিটি। সেখানে ফাঁসির বদলে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি আমৃত্যু কারাদণ্ড, অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই যাবজ্জীবন কারাবাসের পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। ধর্ষণ ও খুনের মামলায় অবশ্য প্রচলিত আইন অনুযায়ীই মৃত্যুদণ্ড হতে পারে।
যেখানে ইচ্ছাকৃত ভাবে খুনের উদ্দেশ্য (মোটিভ) পাওয়া যায়নি, অথচ নির্যাতিতার মৃত্যু হয়েছে, তেমন ঘটনায় কী হবে? কমিটি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ ধারায় একটি নতুন উপধারা যোগ করার সুপারিশ করেছে। সেখানে ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু (রেপ ফলোড বাই ডেথ) এবং ধর্ষণজনিত কারণে পাকাপাকি ভাবে স্বাভাবিক জীবনযাপনে সম্পূর্ণ অক্ষম (ভেজিটেটিভ স্টেট) অবস্থায় চলে যাওয়ার ঘটনাকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে ন্যূনতম কুড়ি বছর এবং সর্বোচ্চ আমৃত্যু কারাদণ্ডের সুপারিশ করা হয়েছে। মুম্বইয়ের অরুণা শনবাগ মামলার কথা এখানে উল্লেখ করেছে কমিটি। |
|
সাংবাদিক বৈঠকে বিচারপতি বর্মা। বুধবার। ছবি: পি টি আই |
শুধু ধর্ষণ নয়, সামগ্রিক ভাবে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধেই প্রশাসন ও বিচারবিভাগকে আরও সক্রিয় হতে বলেছে বর্মা কমিটি। প্রত্যক্ষ হেনস্থার পাশাপাশি যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা, ইশারা ও আচার-আচরণকেও যৌন নির্যাতনের আওতায় এনে কড়া শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। বিচারপতি বর্মার মতে, “আজ যারা রাস্তায় ইভটিজিং করছে, বাসস্টপে মহিলাদের বিরক্ত করছে, কাল তারাই ধর্ষণ করতে পারে। তাই এই ধরনের মানসিক প্রবণতার অঙ্কুরেই বিনাশ জরুরি।”
দিল্লি গণধর্ষণ মামলায় ছ’জন অভিযুক্তের মধ্যে এক জন নিজেকে নাবালক বলে দাবি করেছে। স্কুলের শংসাপত্র অনুযায়ী তার বয়স এখন ১৭ বছর ৬ মাস। কিন্তু ২৩ বছরের তরুণীর উপর ধর্ষণ ও নির্যাতনে যে ভাবে সে অংশ নিয়েছে, তাতে পুলিশ-কর্তারাও বিস্মিত। দাবি উঠেছে, তাকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হোক। তার জন্য অপরাধের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের বদলে ১৬ বছরেই অপরাধীকে প্রাপ্তবয়স্ক ধরা হোক। কিন্তু এই দাবিতে সায় নেই বর্মা কমিটির। কমিটির অন্যতম সদস্য গোপাল সুব্রহ্মণ্যমের বক্তব্য, “এক জন কিশোর যদি ১৬ বছরেই অপরাধী হয়ে ওঠে, সমাজ তার দায় এড়াতে পারে না। শুধু বয়স কমিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করলেই লাভ হবে না। নাবালক অপরাধীদের যে সব আশ্রমে পাঠানো হয়, সেগুলো আরও বড় অপরাধী তৈরির আঁতুড়ঘর।”
তবে দিল্লি ধর্ষণের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা নাগরিক আন্দোলনকে বারবার বাহবা দিয়েছেন বিচারপতি বর্মা। আন্দোলনকারীদের উপরে পুলিশের লাঠিচালনার নিন্দা করেছেন। ধর্ষণের ঘটনার পরে প্রশাসনিক গাফিলতির দায়িত্ব কার, তাই নিয়ে শীলা দীক্ষিতের সরকার এবং কেন্দ্রের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলেছে, সে কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। এমন নৃশংস ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব যে ভাবে পুলিশ কমিশনারের পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন, তার কড়া সমালোচনা করে বর্মা বলেন, “আমি বিস্মিত। ওই পরিস্থিতিতে সারা শহরের মানুষের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।” |
|
বস্তুত আইন সংশোধনের থেকেও বর্মা কমিটি সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের মানসিকতা বদলের দিকেই। রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে এ দেশে যে আইন রয়েছে, তাকে সুষ্ঠু ভাবে বলবৎ করতে পারলেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হতে পারে। অর্থাৎ আইনের দুর্বলতা নয়, আইনের শাসন বাস্তবায়নের গলদ দূর করার উপরেই বেশি জোর দিয়েছেন তাঁরা। বিশেষত যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত মামলায় পুলিশ-প্রশাসনের মানসিকতা নিয়ে আজ বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা হয়েছে, পুলিশের বড় অংশই সমাজকে একটা সংকীর্ণ পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন, তার বদল দরকার। তাই পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কারে জোর দিতে বলেছে কমিটি। রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারার মতো পরিবেশ তৈরি করাও আশু প্রয়োজন, বলেছেন তাঁরা। ধর্ষণের অভিযোগ না নেওয়া এবং তদন্তে
বাধা দেওয়ার অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের কড়া শাস্তির প্রস্তাব রয়েছে।
গত ২৩ ডিসেম্বর কমিটির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি বর্মা। ঠিক এক মাসের মধ্যে প্রায় ৮০ হাজার মতামত খতিয়ে দেখে রিপোর্ট পেশের পরে বর্মা বলেন, “আমরা এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিয়েছি। আশা করি, সরকার তার সমস্ত লোকবল ও সম্পদ কাজে লাগিয়ে আর এক মাসের মধ্যে, সংসদের অধিবেশনের আগেই আইন সংশোধনের খসড়া তৈরির কাজ কাজ সেরে ফেলবে।” কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে আইনমন্ত্রী অশ্বিনী কুমার জানিয়েছেন, বর্মা কমিটির সুপারিশকে সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
|
কিংকর্তব্য |
• অপরাধ প্রমাণ হওয়া অবধি অপেক্ষার দরকার নেই। কারও বিরুদ্ধে আদালতে মামলা গৃহীত হলেই তাঁর ভোটে দাঁড়ানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত।
• খাপ পঞ্চায়েতের বাড়বাড়ন্ত রুখতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। খাপের কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই।
• আফস্পা-র মতো আইনের ফলে যৌন নির্যাতন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে। সেনাবাহিনীর
বিশেষ ক্ষমতার কত তাড়াতাড়ি প্রত্যাহার করা যায়, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
• বিচারে দেরি কমাতে নিম্ন আদালতের উপরে উচ্চ আদালতের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো দরকার। বিচারকদের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
• শিক্ষায় নারী ও শিশুদের প্রতি বৈষম্য দূর করতেই হবে। তার অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় নজরদারি ব্যবস্থা দরকার।
• বৈবাহিক ধর্ষণ আটকাতে সক্রিয় হতেই হবে।
• নিখোঁজ শিশুদের ব্যাপারে প্রশাসনিক ঢিলেমি কাটাতে হবে। সঠিক পরিসংখ্যান রাখতে হবে।
• ধর্ষণ থেকে বাঁচতে কোনও মহিলা যদি কাউকে খুন করে বসেন, সেটা তাঁর আত্মরক্ষার অধিকার বলে স্বীকৃত হবে। |
|
|
|
|
|
|