পাট্টা পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু মেলেনি জমি। ফলে যেখানে ছিলেন সেখানেই রয়ে গিয়েছেন আরামবাগের তিরোল পঞ্চায়েতের নৈসরাই গ্রামের পিচ রাস্তার পাশে ঝুপড়িতে বসবাসকারী ১৯টি পরিবার। শুধু তাই নয়, রাস্তার ধারে শোওয়ার ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
গত শুক্রবার রাতে আরামবাগ-বর্ধমান রোডের পাশে অবস্থিত ওই ঝুপড়িগুলির একটির মধ্যে লরি ঢুকে শ্যামলী লায়েক (৪১) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই জমি দেওয়ার দাবি আরও প্রবল হয়েছে। মৃত শ্যামলী লায়েকের স্বামী পেশায় দিনমজুর কিরীটি লায়েক হলেন একজন পাট্টা প্রাপক। তার অভিযোগ, “বসবাস এবং চাষ করার জন্য ৯ শতক করে মোট ১৯টি পরিবার পাট্টা পেয়েছি। এক বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু এখনও সেই জায়গার অধিকার আমরা পাইনি। যদি ওই জমি পেয়ে যেতাম তা হলে হয়তো আমার স্ত্রীকে এই ভাবে মরতে হত না।’’ ওই একই জায়গায় ১২ বছর আগে একই ভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি লরি ঝুপড়িতে ঢুকে যাওয়ায় ২টি পরিবারের মোট ৬ জনের মৃত্যু হয়। পাট্টা পেলেও বর্তমানে ঝুপড়িরই বাসিন্দা পেশায় দিনমজুর পরমেশ্বর সেন, ভারতী অধিকারী, সুজাতা লায়েক, সন্ধ্যা হাঁসদা, ধনেশ্বর সিং, তুলসী সর্দারেরা বর্তমানে প্রাণের আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অবস্থা এমনই যে, এই শীতের রাতে ঝুপড়ি ছেড়ে তাঁরা যাত্রী প্রতীক্ষালয় কিংবা কোনও দোকানের ছাউনির মধ্যে রাত কাটাতে হচ্ছে।
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অধীন। বাম আমলের শেষ দিকে স্থানীয় ব্লক প্রশাসন ও ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর স্থানীয় তিরোল পঞ্চায়েতের নৈসরাই গ্রামের ১৯ জন ঝুপড়িবাসীকে জমি দেওয়ার জন্য স্থানীয় সাহালালপুরের ১৭৬/১ মৌজার ১৮৮৩, ২৫১০, ও ১৯০৮ দাগের মোট ১ একর ৭১ শতক জমি চিহ্নিত করা হয়। জমিগুলির মালিক স্থানীয় কোঙার পরিবারের কাছ থেকে জমিগুলি কিনেও নেয় সরকার। গত বছরের ১ নভেম্বর ১৯টি পরিবার জমির পাট্টাও পায়। ময়না রায় নামে এক বিধবা পাট্টা প্রাপক বলেন, “পাট্টা দেওয়ার দিন আমাদের টিফিন, চা খাইয়েছিল। ছবিও তুলেছিল পাট্টা দেওয়ার সময়।”
পাট্টা পাওয়ার পর দীর্ঘদিন জমি না পাওয়ার কারণে চলতি বছরের ২০ জুন সংশ্লিষ্ট বিডিও, ভূমি সংস্কার দফতরের ব্লক ও মহকুমা আধিকারিক ও মহকুমা শাসককে গণস্বাক্ষরও দেওয়া হয়। ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর থেকে পাট্টা প্রাপকদের চিঠি দিয়ে জানানো হয় ২৫-২৬ জুলাই জমি জরিপ করা হবে। তারপরে দেখা যায় আরও এক সমস্যা। মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের আধিকারিক লক্ষ্মণচন্দ্র ঘোষ বলেন, “জরিপের কাজ করতে দিয়ে দেখা যায়, ওই জমির সীমানার মধ্যে প্রায় সাত কাঠার একটি পুকুর রয়েছে। কিন্তু ওই জমির দলিল পরচায় তার উল্লেখ নেই। প্রধানত ওই পুকুরের সমস্যার কারণেই প্রকল্পটি আটকে আছে।” আরামবাগের বিডিও প্রণব সাঙ্গুই বলেন, “নানা সমস্যার কারণে ওই প্রকল্পটি বাতিল করে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার জন্য ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের সঙ্গে কথা চলছে।”
শুধু পুকুরই নয়, সমস্যা রয়েছে আরও। চিহ্নিত জমির পাশে যে রাস্তাটি গিয়েছে সেই রাস্তাটি পাট্টা প্রাপকদের ব্যবহার করতে না দেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। পাট্টা প্রাপকদের আরও অভিযোগ, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ ভেদাভেদ তুলে তাঁদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। রাস্তা দেওয়া নিয়ে যাঁরা আপত্তি তুলছেন বলে অভিযোগ, তাঁদের অন্যতম ব্যবসায়ী প্রভাতী নায়েক বলেন, “যে পরিবারটির থেকে সরকার জমি কিনেছে তাঁদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সর্ম্পক দীর্ঘদিন খারাপ। ৪৭ বছর আগে ওই পরিবারের সঙ্গে একটি ঝামেলায় তিন জন মারা গিয়েছিলেন। তারপর থেকেই তো ওই রাস্তাটি বন্ধ। আমাদের ব্যক্তিগত রাস্তা কারওকে দেওয়া যাবে না বলে প্রশাসনকে জানিয়েছি। তবে নিম্নবর্ণ ও উচ্চবর্ণ ভেদাভেদের অভিযোগ মিথ্যা।”
পাট্টা প্রাপকদের প্রতি সরকারী এবং স্থানীয় স্তরে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছেন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর)। সমিতির আরামবাগ মহকুমা শাখার সম্পাদক ঝন্টুলাল পাকড়ে বলেন, “বছর ঘুরে গেল পাট্টা দেওয়া হয়েছে কিন্তু এখনও জমির অধিকার পাবে না কেন? কেনই বা তাঁদের নিম্নবর্ণ বলে মানসিক অত্যাচার করা হবে?” পাট্টা প্রাপকদের জমি না পাওয়ার ঘটনায় তাঁদের অধিকার হরণ করা হয়েছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। সমস্ত বিষয়টা আমরা মানবাধিকার কমিশনে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” |