মানস চক্রবর্তী (১৯৪২-২০১২)
চোখের সামনে রাগ-রূপ যেন দেখতে পেতেন
২/১২/২০১২। সকালটা এক মূর্তিমান বিষাদগ্রস্ততা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজগতের দুই মহীরুহ ইহজগৎ ছেড়ে চলে গেলেন অমৃতলোকে। এক জন বিশ্ববিশ্রুত সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর। অন্য জন কোটালি ঘরানার অনন্য কণ্ঠসঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী। ছ’বছর বয়স থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলাম আমার সঙ্গীতগুরু পণ্ডিত মানস চক্রবর্তীর সঙ্গে। পাখি-পড়ার মতো করে হাতে হাতে ধরে আমাকে উনি শিখিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো। ছেলেবেলা থেকেই ওঁর সাহচর্যে মানুষ হয়ে শুধু একটিই অনুভূতি হত যে, আমি বড় ভাগ্যবান। পর্বতপ্রমাণ ঐ শিল্পীর দেখানো পথ ধরে দিনের পর দিন এগিয়েছি। ছাত্র হিসেবে গুরুর মূল্যায়নে হয়তো অনেকের মনে হতে পারে আমি অতিকথনে দুষ্ট হচ্ছি। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই যে কোনও শ্রোতা সহজে বুঝতে পারতেন কেন মানস চক্রবর্তীর গান অন্য সব শিল্পীর থেকে আলাদা।
ওঁর সঙ্গীতের প্রথম কথাই ছিল মুন্সিয়ানা দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত না করা। সুরই ব্রহ্ম এ কথাটা উনি হৃদয় থেকে অনুভব করতেন। তাই শ্রোতাকে সুরের জাদুতে আপ্লুত করে তার উপরে অনির্বচনীয় ও অমোঘ এক প্রভাব বিস্তার করতে ওঁর প্রয়োজন হত মাত্র কয়েক মিনিট। অথচ, এ কাজ সহজসাধ্য ছিল না। সঙ্গীতাচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর পুত্র হয়ে নিজস্বতা তৈরি করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ ছিল। বাবার সঙ্গীতের নির্যাসটুকু নিয়ে অপরিসীম সাঙ্গীতিক বোধের মাধ্যমে অদ্ভুত ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে নিজস্ব সঙ্গীতকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন উনি। ওঁর প্রতিটা রাগের রূপায়ণ শ্রোতার কাছে ছবির মতো ফুটে উঠত। আসলে, চোখের সামনে নিজে রাগের রূপকে দেখতে পেতেন বলে শ্রোতার হৃদয়ে সেই ছবিকে প্রতিষ্ঠা করা ওঁর কাছে সহজ হয়ে যেত। তাই অনেক শিক্ষার্থীকে বলতে শুনতাম, মানস চক্রবর্তীর কণ্ঠে কোনও রাগ শোনাই সেই রাগের তালিম।
অদ্ভুত সুরেলা ‘বঢ়হত’-এ যখন শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধ, তখন তারার ‘সা’-এর অব্যবহিত পর থেকেই ‘সরগম’ আর ধীর অথচ ভারী তানের সমারোহে মানস চক্রবর্তী এক কল্পলোক সৃষ্টি করতেন। সেই কল্পলোকে পাড়ি দিয়ে শ্রোতা উন্মুখ হয়ে উঠতেন ওঁর কণ্ঠে পরবর্তী ভারী দ্রুৎ এবং ছুট্ তান শোনার জন্য। অত কিছুর মধ্যেও সুরের কামড় এবং দাপট থেকে ওঁর সঙ্গীত কখনও বিচ্যুত হত না। ওঁর পরিবেশনা শেষ হওয়ার পরে তাই শ্রোতার মন এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে ভরে উঠত। বেশ কয়েকটি রাগ সৃষ্টি করেছেন উনি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শ্যামাঙ্গিনী’, ‘বিহঙ্গিনী’, ‘ভূপধ্বনি’ ইত্যাদি।
শুধু কি খেয়াল? ঠুংরি গানেও ওঁর সুর আর আর্তিতে শ্রোতা পেতেন এক অনাস্বাদিত আনন্দ। ঠুংরি গানে লোকসঙ্গীতের ছোঁয়াতে মূলত ‘পূরব’ অঙ্গের ঠুংরি ওঁর গায়নে এক মধুর আবেশ সৃষ্টি করত। আদ্যন্ত সুরের জাদুকর না হলে অগণিত খেয়ালের বন্দিশ অথবা বৈচিত্রময় সব রাগপ্রধান ও আধুনিক গান রচনা করা ওঁর পক্ষে সম্ভব হত না। গুরুর বহু খেয়াল, ঠুংরি, রাগপ্রধান এবং আধুনিক গান যেমন বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি থেকে ডিস্ক হয়েছে, ওঁর রচিত বহু গান আবার অপ্রকাশিতও রয়ে গিয়েছে। সে সবের প্রকাশ বাংলা সঙ্গীতজগতকে সমৃদ্ধ তো করবেই, সেই সঙ্গে শ্রোতৃমণ্ডলীকেও নতুন করে আপ্লুত করবে। পণ্ডিত মানস চক্রবর্তী বেঁচে থাকবেন প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে শিষ্যদের মাধ্যমে, যাঁরা তাঁদের গায়নের দক্ষতায় এরই মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজগতে বিশিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.