গত দু’দশক এটিই ছিল কলকাতায় রবিশঙ্করের সবচেয়ে পছন্দের ঠিকানা।
২০ বালিগঞ্জ পার্ক রোডে তিনতলা বাড়ি। চারদিকে নানা রকমের গাছ দিয়ে সাজানো বাগান, দোতলায় গাড়ি বারান্দা। সেই আটের দশক থেকে কলকাতায় এলে বন্ধু লালা শ্রীধরের সাধের এই আস্তানাতেই থাকতেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। আত্মীয়স্বজনেরাও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন এখানেই।
লালা সাহেবের এই বাড়ির বাগানে ঘেরা খোলা বারান্দায় সেতার হাতে বসে পড়তেন রবিশঙ্কর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত নিজের মনে সঙ্গীত-সাধনা। পণ্ডিতজির মৃত্যুর খবর পেয়ে সে কথাই মনে পড়ছিল ওই বাড়ির বর্তমান কেয়ারটেকার আর এল গুপ্তের। |
বুধবার সকালে পণ্ডিত রবিশঙ্করের মৃত্যুর খবরে শোকাহত ওই বাড়ির পরিচারকেরাও। তাঁরা জানালেন, বাড়ির সামনে পণ্ডিতজির গাড়িটা এলেই হইহই শুরু হয়ে যেত। মেয়ে অনুষ্কা যখন খুব ছোট, তখন বেশ কয়েক বার এসে এই বাড়িতে উঠেছেন রবিশঙ্কর। কখনও কখনও টানা দশ-বারো দিনও তাঁরা থেকেছেন এখানে। শেষ বার তিনি এই বাড়িতে এসেছিলেন ২০০১-০২ সাল নাগাদ, জানালেন কেয়ারটেকার। বললেন, “এই বাড়িতে এসে থাকতে খুব পছন্দ করতেন পণ্ডিতজি।”
২০০৮ সালে লালা সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে বাড়িটি দেখভাল করেন জনা দশেক কর্মী। এ দিন রবিশঙ্করের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে রীতিমতো থমথমে সেখানকার পরিবেশ। পণ্ডিতজি কী খেতে পছন্দ করতেন, কোথায় বসে রেওয়াজ করতেন চলতে থাকে অনর্গল স্মৃতিচারণ। কারও কারও চোখের কোণে তখন ছলছল ভাব।
এ সবের মধ্যেই কথা বলতে শুরু করলেন লালা সাহেবের গাড়িচালক শিবকুমার ঝা। বললেন, “বছর ১০-১২ হয়ে গেলেও মনে হচ্ছে, এই তো সে দিন। আমার গাড়ি চড়ে পণ্ডিতজি কলাকুঞ্জে গিয়েছিলেন। তিনি যে এত বড় শিল্পী, হাবভাবে তা কোনও দিন বুঝতেও দিতেন না। সব সময়েই মুখে হাসি ধরে রাখতেন।”
তিনতলা ওই বাড়ির দোতলায় থাকতেন লালা সাহেব নিজে, একতলা রেখেছিলেন অতিথিদের জন্য। একতলায় ঢুকেই বাঁ দিকে দু’টি বড়বড় ঘর। তারই একটিতে সপরিবার থাকতেন রবিশঙ্কর। সঙ্গীরা কেউ এলে থাকতেন পাশের ঘরটিতে।
কী খাবার পছন্দ করতেন রবিশঙ্কর? আর এল গুপ্তের কথায়, “এই বাড়িতে আমিষ রান্না হয় না। এখানে এলে সাধারণত নিরামিষই খেতেন পণ্ডিতজি। তবে রকমারি আমিষ খাবার নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন তাঁর আত্মীয়-বন্ধুরা। এক-এক সময়ে খাবার এত বেশি হয়ে যেত যে, আমাদেরকেও ভাগ করে দিতেন তিনি।” বালিগঞ্জ পার্ক রোডে লালা সাহেবের এই বাড়িতে থাকার আগে ১০/১ এলগিন রোডে জাহাজ বাড়িতেও এক সময়ে যাতায়াত ছিল পণ্ডিত রবিশঙ্করের। মিলন সেনের ওই বাড়িতে বন্ধু সমাগমও হত তাঁর। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে আড্ডায় মাততেন শিল্পী। তবে তিনের দশকে কলকাতায় এসে উঠতেন ৩৪/১ (এখন তা ৩৫/বি) এলগিন রোডের ভাড়া বাড়িতে। স্যার পি এন মিত্রের ওই বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন দাদা উদয়শঙ্কর। পি এন মিত্রের নাতবৌ অলকা মিত্র বলেন, “শ্বশুরমশাইয়ের কাছে শুনেছি, উদয়শঙ্কর তাঁর ট্রুপ নিয়ে এই বাড়িতে থাকতেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।” |