ইন্দিরার আর্জিতে সুর দূরদর্শনে
কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী • কলকাতা |
ইন্দিরা গাঁধী তখন প্রধানমন্ত্রী। দূরদর্শনের জন্য ‘সিগনেচার টিউন’ তৈরি করতে রবিশঙ্করকে অনুরোধ করলেন। দূরদর্শনের অনুষ্ঠান শুরুর আগে শোনা যাবে যে আবহসঙ্গীত। ১৯৯৭-এর ৮ মার্চ আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে এক সাক্ষাৎকারে পণ্ডিত রবিশঙ্কর নিজেই বলেছিলেন ইন্দিরার সেই অনুরোধের কথা। অনেক আগে তাঁরই সুরে ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আর্জি, দূরদর্শনের জন্য ওই রকম একটা সুর হলে ভাল হয়! রবিশঙ্কর জানিয়েছিলেন, ইন্দিরার প্রস্তাব তাঁর খুব ভাল লেগেছিল। ১৯৪৫। আইপিটিএ-র সাংস্কৃতিক স্কোয়াডে যোগ দিয়ে রবিশঙ্কর গিয়েছেন মুম্বইয়ের আন্ধেরিতে। সেখানেই গাওয়া হয়েছিল ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’ গানটি। কিন্তু খুব ধীর লয়ে। শুনেই গানটিতে নতুন করে সুর দেওয়ার কথা ভাবেন। পরে নিজেই বলেছেন, “সুরটি জনপ্রিয় হয়ে গেল। স্বাধীনতার পর সেনা বাহিনীতেও তা জনপ্রিয় হল। ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানের সুরের পর সারা দেশে সব চেয়ে জনপ্রিয় সুর এটিই।” প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শনের ‘সিগনেচার টিউন’-এর জন্য ওই রকম একটা সুর চাওয়ায় তাই খুশিই হয়েছিলেন রবিশঙ্কর। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’-র প্রথম লাইনের সুরের আদলেই তিনি টিউনটি বানালেন। মহাত্মা গাঁধীর প্রতি শ্রদ্ধায় তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘মোহনকোষ’ রাগ সৃষ্টি করেছিলেন রবিশঙ্কর। রাগ সৃষ্টির সময় গাঁধীর নামটি তাঁর মাথায় ছিল বলে জানিয়েছিলেন ওই সুরস্রষ্টা।
|
তাঁর বাজনায় ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্য। সেতারের সেই ঝংকার শুনলে বলে দিতে হয় না, এ তাঁরই আঙুলের ছোঁয়া। রবিশঙ্করের বাজনা সম্পর্কে ঠিক এই কথাটাই বলছিলেন সেতারবাদক দেবু চৌধুরী। বলছিলেন, “ওঁর বিলম্বিত আলাপের ধরন ছিল অননুকরণীয়, ওঁর বাজনায় ধ্রুপদের প্রভাব ছিল।” শাহিদ পারভেজ বললেন, “প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে, নতুন নতুন রাগ সৃষ্টির মাধ্যমে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন তিনি।” তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার বললেন, “তিনিই প্রথম সেতারে নিচের (বেস-এর) খরজ-পঞ্চম এবং খরজের ‘সা’ তার ব্যবহার করেছিলেন।” এই ধারা যে তিনি পেয়েছিলেন মাইহার ঘরানা থেকে, তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মাইহার ঘরানার অন্য অনেকের মতোই তাঁর বাজনার একটা নিজস্ব অননুকরণীয় ‘টোন’ ছিল।”
|
কেমন ছিলেন শিক্ষক রবিশঙ্কর? তাঁর শিষ্যরা বলছেন, তাঁর শিক্ষা দেওয়ার ধরন যেমন প্রথা মেনে চলতো না সব সময়, তেমনই প্রাতিষ্ঠানিক গুরু-শিষ্য সম্পর্কে নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন না তিনি। সরোদবাদনে রবিশঙ্করের একমাত্র শিষ্য পার্থসারথি বললেন, “পণ্ডিতজির শিক্ষাদানের পদ্ধতিটা ছিল একেবারে অন্য রকম। কখনও বাজিয়ে, কখনও গেয়ে, কখনও বেড়াতে বেড়াতে উনি এত সহজ ভাবে শেখাতেন যে, এক বারেই সব কিছু মাথায় গেঁথে যেত। কোনও দিন ওঁকে রেগে যেতে দেখিনি।” সেতারবাদ শাহিদ পারভেজ বলছেন, “প্রাতিষ্ঠানিক গুরু-শিষ্য সম্পর্কের স্তরে তালিমকে আবদ্ধ না রেখে নিজে হাতে শিষ্যদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাজাতেন।”
|
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন |
ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন রবিশঙ্কর। দু’মাস আগেও। রবিশঙ্কর সম্পর্কে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে জানিয়েছেন সন্তুর বাদক সতীশ ব্যাস। তিনি বলেন, “ঠিক দু’মাস আগে আমেরিকায় আমি তাঁর সঙ্গে একটি সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম। তখনই আমার সঙ্গে তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বতর্মান অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তিনি জানতে চেয়েছিলেন দেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হয় কি না, বা এই ধরনের অনুষ্ঠান কর্পোরেট সহযোগিতা পায় কি না?” ওই বয়সেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্য কিছু করার জন্য রবিশঙ্কর মুখিয়ে থাকতেন বলে জানিয়েছেন সতীশ ব্যাস।
|
রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য হয়েছিলেন রবিশঙ্কর। ১৯৮৬ -’৯২ সাল পর্যন্ত মেয়াদে এক বারই সভার কাজে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন তিনি। অন্তত রাজ্যসভার ওয়েবসাইট তেমনই তথ্য দিচ্ছে। তিনি স্কুল শিক্ষায় সঙ্গীতচর্চা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রকের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী এল পি শাহি জানান, সরকার স্কুলস্তরে সঙ্গীতচর্চার জন্য উদ্যোগী হচ্ছে। বুধবার রবিশঙ্করের স্মরণে সংসদের দুই কক্ষেই নীরবতা পালন করা হয়। |