মকবুল ফিদা হুসেন একদা এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, নারীর প্রতি আকর্ষণ যে দিন চলে যাবে, সে দিন থেকে তিনি আর ছবি আঁকতে পারবেন না। রবিশঙ্কর অবশ্য স্পষ্ট ভাবে বলে যাননি, বহুগামিতা তাঁর সুর মূর্ছনার প্রেরণা কি না। কিন্তু তাঁর বর্ণময় জীবনসাগরে ঢেউয়ের মতো অবিরত আসা নারীদের কথা, তাঁদের সঙ্গপ্রিয়তার কথা রবিশঙ্কর কখনও গোপন করেননি। আত্মজীবনী ‘রাগমালা’-য় লিখেছেন, “নিত্যনতুনের প্রতি একটু ঝোঁক ছিল আমার।”
কতকটা রসিকতার ঢঙেই রবিশঙ্কর আত্মজীবনীতে বলেছেন, “আমার মনে হয়, আমি এক এক জায়গায় এক এক জন নারীর প্রেমে পড়েছি। এটা অনেকটা ওই প্রতিটি বন্দরে নাবিকের এক জন করে মহিলা থাকার মতো। আবার আমার ক্ষেত্রে কখনও কখনও একটি জায়গায় একের অধিক নারী।” তাঁদের কেউ নৃত্যশিল্পী, কেউ কনসার্ট প্রোডিউসার কেউ বা অভিনেত্রী।
এবং ওই নারীদের সঙ্গে পুরোদস্তুর সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন রবিশঙ্কর। শিল্পীসত্তা পরের কথা, এমনিতেই সুপুরুষ রবিশঙ্করের শরীরের প্রতি নারীদের অমোঘ আকর্ষণ থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কে শরীর অবশ্যই একটা বড় জায়গা নিয়ে ছিল, সবটা ছিল না।
১৯৮৯-এর ২৩ জানুয়ারি জীবনে দ্বিতীয় বার বিয়ের পিঁড়িতে বসে রবিশঙ্কর যখন অনুষ্কার মা, ৩৫ বছরের সুকন্যা রাজনকে স্ত্রীর মর্যাদা দিলেন, তখন তাঁর বয়স ৬৯। তার দু’বছর আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছে। রবিশঙ্কর ও সুকন্যার কন্যা, ১৯৮১-র ৯ জুন জন্ম নেওয়া অনুষ্কা তখন সাড়ে সাত বছরের। হায়দরাবাদের কিছুটা দূরে এক মন্দিরে সেই বিয়ের দিন ঘনিষ্ঠ মহলে রবিশঙ্কর জানান, একটানা ভবঘুরে জীবন নিয়ে হাঁফিয়ে উঠে ঘর পাতার জন্য ওই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি। |
মুম্বই ২০০৬। স্ত্রী সুকন্যার সঙ্গে। ছবি: পি টি আই
|
সুকন্যার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ১৯৭২ থেকে। সুকন্যা তখন অষ্টাদশী। সেই সুকন্যা, যিনি মাঝেমধ্যে রবিশঙ্করের কনসার্টে তানপুরা বাজাতেন। দু’জনের সম্পর্কের ন’বছর পর এল অনুষ্কা। সুকন্যা যখন রবিশঙ্করের সন্তান স্বেচ্ছায় গর্ভে ধারণ করতে চান, রবিশঙ্কর রাজি হয়েছিলেন একটাই শর্তে সন্তানের পিতৃপরিচয় গোপন রাখতে হবে। সুকন্যা তখন অন্য এক জনের স্ত্রী। রবিশঙ্করের শর্তে রাজি হয়ে তাঁর সন্তানের মা হয়েছিলেন।
এক জন শিল্পী, এক জন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনসঙ্গী হতে গেলে যতটা উদার হতে হয়, তার চেয়েও বেশি উদারতা ছিল সুকন্যার। তাঁর বক্তব্য, “রবিজি তো আর সাধারণ মানুষ নন। উনি পণ্ডিত রবিশঙ্কর। অন্যদের সঙ্গে ওঁকে ভাগ করে নিতে হলে আমার কিছু মনে করা সাজে না।” সুকন্যার কথায়, “যখন ঠিক করলাম ওঁকে বিয়ে করবই, উনি বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারব না। তো আমার কিছু যায়-আসেনি।”
সুকন্যার গর্ভে যখন অনুষ্কা, সেই সময়ে এক নারীর সঙ্গে ১৪ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হয় রবিশঙ্করের। তিনি কমলা শাস্ত্রী। তার সঙ্গেই সম্ভবত রবিশঙ্করের জীবনের প্রথম প্রেম। রবিশঙ্করের মেজ বউদি লক্ষ্মী শাস্ত্রীর বোন ওই নৃত্যশিল্পী কমলা। মনে হয়, প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। কারণ, তিনি বলেছেন, “কমলাকে দেখেই ঘোর লেগে গিয়েছিল আমার।” সেটা ১৯৪৪। আর ১৯৬৭-তে কমলা ও রবিশঙ্কর লিভ-টুগেদার করতে শুরু করেন। যে-সম্পর্কের শেষ হয় ১৯৮১-র গোড়ার দিকে। কিন্তু দু’জনের সম্পর্ক গভীর হলেও বিয়ে হয়নি। সম্ভবত তার কারণ, ওই সময়কালের মধ্যে রবিশঙ্কর ও তাঁর প্রথম স্ত্রী, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের কন্যা রোশানারা তথা অন্নপূর্ণার আইনি বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। অন্নপূর্ণা ডিভোর্স দিতে রাজি ছিলেন না। তার পর হঠাৎ করে ১৯৮২ সালে অন্নপূর্ণা যখন নিজেই আইনি বিচ্ছেদ চান ও পাওয়ার পর ১৯৮৩-তে তাঁরই ছাত্র, ১৪ বছরের ছোট রুশি পান্ডিয়াকে বিয়ে করেন, কমলা তত দিনে রবিশঙ্করকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
তার প্রায় দু’দশক পরেও শ্রদ্ধার সঙ্গে কমলা শাস্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন রবিশঙ্কর, “নিত্যনতুনের প্রতি একটু ঝোঁক ছিল আমার। ওই সব কামনা চরিতার্থ করার পথে কমলা কখনওই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।”
রবিশঙ্করের কলকাতার এক শিষ্যের কথায়, “টানা ১৫ বছর গুরুজির সঙ্গে থাকার সুবাদে আমি তাঁর জীবনে আসা তিন নারী কমলা শাস্ত্রী, সুকন্যা রাজন ও সু জোন্সকে কাছ থেকে দেখেছি। তিন জনের সঙ্গেই সুন্দর সম্পর্ক ছিল তাঁর। কোনও সম্পর্ক কেন ভেঙে যায়, সেটা সম্পর্কে আবদ্ধ থাকা দু’জনই কেবল বলতে পারেন। কিন্তু আমি দেখেছি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরেও সেই সব নারীর প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন গুরুজি।”
তবে সেই কমলাই যখন জানতে পারেন রবিশঙ্কর ও নিউ ইয়র্কের কনসার্ট প্রোডিউসার সু জোন্স-এর ভালবাসার ফসল নোরা জোন্স-এর অস্তিত্বের কথা, তাঁর পক্ষে রবিশঙ্করের সঙ্গে থাকা আর সম্ভব হয়নি। নোরার জন্ম ১৯৭৯-তে। নোরাই রবিশঙ্করের বড় মেয়ে আর অনুষ্কা ছোট। কমলা ছেড়ে গেলেও সু-র সঙ্গে রবিশঙ্করের সম্পর্ক ও নোরার কথা জানার পর সুকন্যা কিন্তু বিচলিত হননি। যদিও সুকন্যার সঙ্গে বিয়ের খবরে সু কয়েক বছরের জন্য রবিশঙ্করের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, এমনকী নোরার সঙ্গেও রবিশঙ্করকে দেখা করতে দিতেন না। তবে রবিশঙ্করের মতো মানুষকে যে একটি সম্পর্কের শিকলে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়, সেটা সুকন্যা বিলক্ষণ জানতেন।
যেটা হয়তো জেনেও অন্য রকম ভেবেছিলেন অন্নপূর্ণা। আসলে রবিশঙ্কর নিজেই স্বীকার করেছেন, ১৯৪১-এ বিয়ে করা অন্নপূর্ণার প্রেমে সে ভাবে পড়েননি তিনি, যদিও অন্নপূর্ণা গভীর ভাবে ভালবাসতেন তাঁকে। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে রবিশঙ্করের সম্পর্ক যখন একটা আকার নিচ্ছে, সেই সময়েই রেগেমেগে প্রথম বাপের বাড়ি চলে যান অন্নপূর্ণা। ফাটলের সেই শুরু, তার পর চিরতরে ভাঙন।
তাঁর অনুজ এই বঙ্গের এক শিল্পীর বিশ্বাস, “সুরসৃষ্টির মতোই রবিশঙ্কর সিরিয়াস ছিলেন ওই সব সম্পর্কে। হতে পারে বহু সম্পর্কে জড়িয়েছেন, কিন্তু সে সব তাঁর কাছে সত্যিকার সম্পর্ক ছিল, খেলা ছিল না।” |