|
|
|
|
বিনোদন |
|
ঘরানা ভেঙে সেতারের বিশ্বনাগরিক
সুব্রত রায়চৌধুরী |
|
সেতার বাজিয়েই যুগযুগান্তের জাতপাত ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কে ধ্রুপদী সঙ্গীত বোঝে, কোন ঘরানা থেকে উঠে এসেছে বা রাগরাগিণী শব্দটা আদতে শুনেছে কিনা, তা নিয়ে রবিশঙ্কর কোনও দিনই ভাবিত ছিলেন না। সকলের জন্যই দরজা খুলে দিত তাঁর বাজনা। এক বার নিউ ইয়র্কের এক ট্যাক্সিওয়ালাকে দেখলাম, অক্লেশে প্রশ্ন করল, ‘হোয়েন আর ইউ কামিং ব্যাক, রবি’? আটের দশকেও ভারতীয়দের সঙ্গে ব্রিটিশ অভিবাসন দফতরের অফিসাররা বেশ দুর্ব্যবহার করতেন। কিন্তু তখনও ব্রিটিশ ইমিগ্রেশনের এক কর্তা রবিশঙ্করকে দেখেই আপ্লুত, ‘একটা অটোগ্রাফ দেবেন, স্যার?’
রবিশঙ্করের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওখানেই। মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। ডোভার লেনে দেড় ঘণ্টা বা কার্নেগি হলে ১৫ মিনিটের ‘পিস’, তার মধ্যেই নিয়ে আসতেন যথাসম্ভব বৈচিত্র্য। তাঁর চেহারা, কথাবার্তা বা বাজানো, সর্বত্র আসল কথা একটিই। কমিউনিকেশন! সব রকমের মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করত তাঁর বাজনা।
এই কমিউনিকেশনটা তৈরি হল কী ভাবে? রবিশঙ্কর প্রথম থেকেই একটা বিষয়ে সচেতন ছিলেন। রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন!
স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মানে? উত্তর ভারতে বেশির ভাগ ঘরানাই সৃষ্টি হয়েছে তানসেন থেকে। কিন্তু তখন যোগাযোগ এত সহজ ছিল না। একই গুরুর কাছ থেকে এসে কেউ কলকাতায় শেখালেন এক রকম, জয়পুরে অন্য রকম। ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরলিপি সে ভাবে বিশদে নেই, সবই তখন গুরুর কাছে শোনা বিদ্যা। শ্রুত বিদ্যায় কেউ হয়তো কোনও রাগের চলনে দু’টো নি লাগিয়ে দিলেন, কেউ নি-র সঙ্গে সা। কোনওটাই ভুল নয়। কিন্তু পরবর্তী কয়েক পুরুষ ধরে শিষ্যরা লড়ে গেলেন, ‘আমার গুরু এই ভাবে শিখিয়েছিলেন। এটাই শুদ্ধ।’ |
|
কিন্তু পঞ্চাশের দশকে দেশ স্বাধীন। রেলগাড়ি, পোস্ট অফিস, রেডিওর দৌলতে যোগাযোগ অনেক সহজ। তখন ওই ঝগড়াটা রেখে লাভ কী? কোনও বিদেশি হয়তো গান শিখতে এলেন। একই রাগ গ্বালিয়রে এক গুরু এক ভাবে শেখালেন, আগরায় আর এক গুরু অন্য ভাবে। সে তো ভয়ে পালাবে। কোনটা ঠিক?
রবিশঙ্কর শুরু থেকে রাগ রূপায়ণের এই ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’ তৈরির চেষ্টা করেছেন। এবং কোনও ভেদাভেদ মানেননি। একটা উদাহরণ দিই। তাঁর গুরু বাবা আলাউদ্দিন খান মেঘ রাগের অন্তরায় শুদ্ধ নিখাদ প্রয়োগ করতেন। আমির খান অবশ্য আগাগোড়া কোমল নি লাগাতেন।
রবিশঙ্কর কিন্তু নিজের প্রতিভামাফিক ব্যাপারটা ‘এডিট’ করে নিলেন। মাইহার ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে শুধু কোমল নি-টাই রাখলেন। ভারতের সর্বত্র ওটিই বেশি ব্যবহৃত হত যে! স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের খাতিরে এই ধরনের ‘এডিটিং’ ধ্রুপদী সঙ্গীতে ছিল না। যে যার ঘরানা তোতাপাখির মতো আউড়ে যেত। রবিশঙ্করই যুক্তি, বুদ্ধি এবং শিক্ষা দিয়ে তোতাকাহিনীর বাইরে ধ্রুপদী সঙ্গীতকে বের করে আনলেন।
রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের পাশে তালকেও প্রাধান্য দিলেন রবিশঙ্কর। তিনিই প্রথম বুঝলেন, তবলার তাল মোটেই সহযোগী শিল্প নয়। কিষেণ মহারাজ, কেরামতুল্লা খান, আল্লারাখার তবলায় রয়েছে ছন্দ। ফলে, সেতার বাজাতে বসে তবলাকেও ছাড়া হল কিছুটা জায়গা। সেতারের সুরে ঢুকে এল তাল আর ছন্দ। আপনি-আমি যে ভাবে নিঃশ্বাস নিই, যে ভাবে কথা বলি, সবের মধ্যেই তো থাকে ছন্দ। রবিশঙ্করের বাজনার হাত ধরেই সঙ্গীতে সেই ছন্দ খুঁজে পেল পৃথিবী। তিনিই হয়ে উঠলেন ভারতের অন্যতম ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার।’ বছর কয়েক আগে বিবিসিতে ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’ নামে অনুষ্ঠান। মহাত্মা গাঁধীর জন্য বরাদ্দ ৫ মিনিট, জওহরলাল নেহরুর জন্য ২ মিনিট। আর রবিশঙ্কর ৩৫ মিনিট!
ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে দেওয়া, তালবাদ্যকে প্রাধান্য দেওয়া...এটা রাগরাগিণী ভাল না জানলে হয় না। বাবা আলাউদ্দিন খানের কাছে তাঁর পুত্র আলি আকবর খান থেকে বাহাদুর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রায় সব শিষ্যই মার খেয়েছেন। সামান্য ভুলচুক হলেই খড়মপেটা করতেন বাবা। এক মাত্র রবিশঙ্করের গায়ে কোনও দিন হাত দেননি। সেই রকম ভুল তাঁর হতই না! আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানেও তাই প্রৌঢ় রবিশঙ্কর সেতারে আলাপের পর জোড় বাজাতেন। জোড়ের চারটি ভাগ। বিলম্বিত জোড়, মধ্যলয় জোড়, গমক জোড় আর লোরি জোড়। বেশির ভাগ বাজিয়ে দু’ একটা জোড় বাজিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু রবিশঙ্কর চারটিই বাজাতেন। ওই জোড় বাজানো শেষ হয়ে গেল!
সেতারের কাঠামোও বদলে দিয়েছিলেন তিনি। রুদ্রবীণার আদলে তাঁর সেতারে খড়জ আর পঞ্চমে মোটা তার। যন্ত্রটা সুরবাহার আর সেতারের মাঝামাঝি। লখনউয়ের ইউসুফ আলি খানকে দিয়ে ওই যন্ত্র তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা আলাউদ্দিন।
প্রথাগত সেতারের বাইরে এই যন্ত্রে মন্দ্রসপ্তকে আরও একটি ‘অক্টেভ’ বেড়ে গেল, আলাপ এবং জোড়ে চমৎকার বাজে। কিন্তু তার পর? কলকাতার নদেরচাঁদ মল্লিকের সাহায্যে দুটো হুক তৈরি করলেন রবিশঙ্কর। খড়জ, পঞ্চমে পারফেক্ট সুরে, অনায়াস সাবলীলতায় যাতায়াত করে শেষ দিকে হুক লাগিয়ে তবলার সঙ্গে গৎ বাজাতেন। এক যন্ত্রে সুরবাহার এবং সেতার দুটোর সুবিধাই নিতেন তিনি। এখন সবাই রবিশঙ্করের আদলে সেতার তৈরি করান এবং প্রথম থেকেই হুক লাগিয়ে দেন। রবিশঙ্কর এটি করতেন না। অনায়াসেই চারটি তারে ঘোরাফেরা করে সুন্দর সঙ্গীতের সৃষ্টি করতেন। |
|
|
রবিশঙ্কর কৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন।
আমাদের কাছে উনি ঈশ্বরের মতোই।
লতা মঙ্গেশকর |
|
ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হারাল তার প্রধান দূতকে।
দেশ হারাল ভারতরত্নকে।
এ আর রহমান |
|
|
|
রবিশঙ্কর ছিলেন সঙ্গীত, শিল্প ও
সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক ‘আইকন’।
প্রণব মুখোপাধ্যায় |
|
বিশ্বে ভারতীয় সংস্কৃতির
অন্যতম দূত ছিলেন তিনি।
মনমোহন সিংহ |
|
|
|
ভৌগোলিক সীমানা ছাপিয়ে তাঁর
সৃষ্টিশীলতা সকলেরই হৃদয় স্পর্শ করত।
এম কে নারায়ণন |
|
বাংলার সঙ্গে রবিশঙ্করের গভীর যোগাযোগের
স্মৃতি হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
|
|
রবিশঙ্করকে চিনতাম বলে লন্ডনে
মেয়েমহলে আমার কদর বেড়ে গিয়েছিল।
শেখর কপূর |
|
|
এই প্রতিভাই ‘বিট্ল’ জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে সেতার বাজাতে পারে, ইহুদি মেনুহিনকে দিয়ে পিলু রাগ বাজাতে পারে। ফিউসন মিউজিক তো মুম্বইয়ের ছবিতে রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক অনেক আগেই শুরু করেছিলেন। স্যাক্সোফোনের সঙ্গে সেতার বা গিটারের সঙ্গে তবলা। কিন্তু রবিশঙ্কর নিজে মিউজিক কম্পোজ করে ইহুদি মেনুইনকে দিয়ে বাজিয়েছেন। পিলুর শুদ্ধতা এক চুলও এ দিক-ও দিক না করে ‘ইম্প্রোভাইজ্ড ফিউসন’ নয়, ‘কম্পোজ্ড ফিউসন।’
তাঁর অস্তিত্বের আলাপ আর ঝালার মাঝে মিশেছিল আরও অনেক কিছু। সুপুরুষ চেহারা ও চর্চিত বৈদগ্ধ্য। মাইহারে রবিশঙ্করের ছবি দেখবেন, সরু গোঁফ তরুণ। দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গে প্যারিসে গিয়ে যা কিছু শিখেছিলেন, সবই ঝেড়ে ফেলেছেন। শুধুই যেন বারাণসীর তরুণ।
পরে বুঝলেন, বাজনার সঙ্গে বদলাতে হবে চেহারা, হাবভাব, কথাবার্তা। সুপুরুষ রবিশঙ্কর তখন কলারওয়ালা ‘গুরু’ পাঞ্জাবি পরেন। তাঁর ফ্যাশনসচেতনতা প্রথম দেখাল, ট্রাউজার্সের সঙ্গে ওই রকম পাঞ্জাবিও গায়ে দেওয়া যায়। সত্তর দশকের শেষাশেষি সামান্য ভুঁড়ি হয়েছে। বালিগঞ্জ পার্ক রোডের বাড়িতে বসে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘না, এটা শিগ্গির বাতিল করতে হবে।’ তেলমশলা তখনই বাদ, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে আসতে শুরু করল কন্টিনেন্টাল লাঞ্চ। পরের বার বিদেশ থেকে এলেন, ছিপছিপে চেহারা।
শুধু চেহারা? প্রথাগত লেখাপড়া না শিখেও হাবভাবে নিয়ে এসেছেন বৈদদ্ধ্য। নিজে মদ পছন্দ না করলেও ভাল ওয়াইন কোথায় পাওয়া যায়, ভাল ছবি কী ভাবে কিনতে হবে, লন্ডনে ভাল থিয়েটার কী চলছে সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারেন। লন্ডনের লর্ড মাউন্টব্যাটেন হলে বাজাতে নয়, ৭৫ মিনিটের বক্তৃতা দিতে এসেছেন রবিশঙ্কর। সকলে অবাক হয়ে শুনছে তাঁর কথা। মাইহারের সরু গোঁফ নিজের চেষ্টায় হয়ে উঠেছেন এক জন বিশ্বনাগরিক।
এই বিশ্বনাগরিকের মধ্যে লুকিয়ে আছে ছাত্রদরদি, প্রেমিক সত্তা। আবার, নিজের স্টারডম নিয়ে পূর্ণ সচেতন। ক্যালিফোর্নিয়ায় এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকাররা অনেকে খেতে যেতেন। সকলে হইহই করে দরজা পেরিয়ে যেতেন, রবিশঙ্কর গ্যাঁট হয়ে গাড়িতে বসে থাকতেন। ম্যানেজার এসে দরজা না খুলে দিলে তিনি নামবেন না।
এক দিকে বারাণসীর তরুণ, অন্য দিকে ক্যারিশমাটিক তারকা। পরস্পরবিরোধী এই দুটি সত্তাকে আজীবন বয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। যিনি রেড মিটের সঙ্গে কোন রেড ওয়াইন ভাল যায়, তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চালাতে পারেন, তিনিই উড়ানে উঠে বিমানসেবিকাকে সটান জিজ্ঞেস করেন, ‘মাংসটা কীসের? গোরু বা শুয়োর হলে দিয়ো না।’ প্রতিভাবানরা এই রকমই হন।
প্রতিভা! মাইহার ঘরানার সন্তান রবিশঙ্করের ঘরের নাম আসলে সেটাই। ভবিষ্যতে হয়তো অনেক বিখ্যাত সেতারবাদক আসবেন, কিন্তু প্রতিভা দিয়ে নতুন ব্যাকরণ তৈরি? রবিশঙ্করেই সেই ঘরানার শুরু ও শেষ! |
|
|
|
|
|