বিনোদন
আমার দাদা
কী আর বলব দাদার সম্বন্ধে! ছোটবেলায় বছর দশেক বয়স থেকে দাদাকে পেয়ে এসেছি একাধারে পিতা, গুরু এবং বন্ধু হিসেবে। ওঠা, বসা, চলা, দেখা; প্রথম শিক্ষাও ওঁর থেকে প্রায়। জীবনের রং রঙ্গরস সুর লয় রাগ অনুরাগের প্রতি আমার যে অশেষ টান সেটাও দাদার অনুপ্রেরণায়। দেবতা ছিলেন না উনি। দোষে গুনে মানুষই ছিলেন তবে অসাধারণ অসামান্য মানুষ ছিলেন।
সেই যে ১৯৩০ সালে ভারত থেকে ট্রুপ নিয়ে গেলেন প্যারিসে, সঙ্গে আমরা তিন ভাই মেজদা রাজেন্দ্র, সেজদা দেবেন্দ্র ও আমি (আমি তখন রবীন্দ্রশঙ্কর মাত্র, অত্যন্ত নাবালক), আমার খুড়ো কেদারশঙ্কর ও তাঁর মেয়ে কণকলতা, বেচুদা অন্নদা ভট্টাচার্য, মাতুল ব্রজবিহারী ও তিমিরবরণ এবং বিষ্ণুদাস শিরালী। প্যারিসে ওঁর সঙ্গে ওঁর বান্ধবী সিমকিও এল। শুরু হল উদয়শঙ্কর কোম্পানি অফ হিন্দু ড্যান্সার্স অ্যান্ড মিউজিসিয়ান্স এবং প্যারিসে একটা বাড়ি ভাড়া করে কেন্দ্রটা চালু হল। আমার মা-ও বছর দুয়েকের জন্য ওখানে গিয়েছিলেন। ওই বাড়িতেই আমরা সবাই থাকতাম আর দিনরাত রিহার্সাল চলত। তার পর আট বছর ধরে যা হল সে তো একটা ইতিহাস। দেশে ও বিদেশে উনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি সুপার স্টারডম পেয়েছিলেন। মনে আছে বাইরের লোকেরা সে সময়ে রবীন্দ্রনাথকে কিছু কিছু জানত। আর জানত মহাত্মা গান্ধীকে। কিন্তু ভারতকে সেই অর্থে জানতে ও ভালবাসতে শুরু করল লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই সময়টায় দাদাকে দেখে। ভগবানের অশেষ কৃপা ও আর্শীবাদ ছিল এই মানুষটার উপর।
ওঁর রূপ গুন যশ অর্থ বীর্য যেন উপচে পড়ছিল অনবরত স্টেজে সাপুড়ের চেহারায়, গন্ধর্বের সাজে ইন্দ্র, রাজপুত বীর, কিংবা কৃষ্ণরূপে। যখনই যে নাচে নামতেন মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখত। আর জগাসুর বধ বা হর পার্বতী নৃত্যম্বন্ধে যখন শিবের ভূমিকায় নামতেন সঙ্গে পার্বতীর নাচে সিমকিকে নিয়ে, তখন কার না মনে হয়েছে ওঁরা সাক্ষাৎ হর-পার্বতী? অদ্ভুত সুন্দর একটা শরীর এবং অঙ্গসৌষ্ঠব ছিল ওঁর। লালিত্যের সঙ্গে মিশে থাকত পৌরুষ।

দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গে।—ফাইল চিত্র
আজকাল যাকে সেক্স অ্যাপিল বলে সেটা যেন ঝরে পড়ত ওঁর দেহ থেকে! যেখানে গেছি দেখেছি সেই একটি জিনিস ওঁর সঙ্গ পাবার জন্য মেয়েরা পাগল। শুনেছি কত গল্প রাজা নবাব বাদশাহের সম্বন্ধে! কবিরেজি, হাকিমি ওষুধ হিরে সোনা মতিভস্ম খেয়ে তাদের যৌনশক্তি ও ভোগ করার ক্ষমতা সর্ম্পকে, কিন্তু দাদাকেই দেখেছি ভগবানের তৈরি এক বীর্যক্ষম মানুষ। কি অক্লান্ত ভাবে জীবনটা ভোগ করে গেলেন! সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে গেলেন ভারতীয় নাচ গান বাজনা দিয়ে ব্যালে। মঞ্চের উপর সাজ পোষাক ডেকর এবং আলোর ইন্দ্রলোক। একটা নতুন ধারা শুরু করলেন যার উপর ভিত্তি করে আজকের ভারতের সমস্ত ক্রিয়েটিভ ড্যান্স প্রোডাকশন দাঁড়িয়ে আছে।
দাদার শিল্পী জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু ১৯৩৯ সাল থেকে যখন উনি আলমোড়াতে উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া ক্যালচার সেন্টার শুরু করেন। আমার তো মনে হয় এটাই ছিল দাদার জীবনের পীক পিরিয়ড। ব্যালের ক্ষেত্রে ‘রিদিম অফ লাইফ’ এবং ‘লেবার অ্যান্ড মেশিনারি’ ওঁর এই সময়েরই কাজ। একটা উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন উনি রবীন্দ্র শতবর্ষে। কবিগুরুর লেখা ‘সামান্য ক্ষতি’র উপর। সঙ্গীত আমি করেছিলাম। দাদা কিছু আলোর স্পেশাল এফেক্ট দিয়েছিলেন। তবে ওঁর শেষ বিস্ময়কর সৃষ্টি হল এই কয়েক বছর আগে করা শঙ্করস্কোপ। যাতে উনি অদ্ভুতভাবে সিনেমা ও স্টেজের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন এক নিজস্ব টেকনিকে। সুধিসমাজ এটা খুব পছন্দ করেননি এর বিষয়বস্তুর জন্যই হয়তো।
আমাদের দেশের অনেক সমালোচক এবং উন্নাসিক পিউরিস্টরা চিরদিনই বলে এসেছেন নানান কথা। যেমন, দাদা পিওর কোন ঢং-এ নাচেন না অথবা রচনা করেন না। অর্থাৎ কথাকলি, ভারতনাট্যম, মণিপুরী বা কত্থক কোন একটা এক ধরনের শুদ্ধতা বজায় রাখতে কিছু করেননি। তাঁদের সমালোচনা এ ধার দিয়ে হয়তো ঠিক। তবে একটা জিনিস আমি বলব যাঁরা কেবল শুদ্ধ ঢং-এ নৃত্য পরিবেশন করেছেন ও করবেন দাদাকে তাঁদের স্তরে বা তাঁদের মাপকাঠিতে বিচার করা ভুল।
অনেকেই হয়তো জানেন লন্ডনে থাকাকালীন কিভাবে ছবি আঁকতে আঁকতে ক্রমে নাচের লাইনে এলেন। সেনসিটিভ চিত্রকরদের মনশ্চক্ষু দিয়ে তিনি তখন ভারতীয় মন্দিরে পুরাণ ভাস্কর্যের মধ্যে গতি দেখতে পেলেন। ওঁর আদি গুরু হলেন প্রসিদ্ধ নটরাজ। ওঁকে প্রেরণা জোগাল ইলোরা অজন্তা এলিফেনটা আবু কোনারক খাজুরাহো ও মহাবলীপুরমের পাথরের খোদাই করা কাজ। তারপর ১৯২৯ সালে যখন ভারতে ফিরলেন তখন প্রায় বছর খানেক চারিদিকে ঘুরে দেখলেন কথাকলি, ভারতনাট্যম, ছৌ, মণিপুরী এবং আরও অনেক আদিবাসি নৃত্য।
দাদা সাধারণ হিসাবে বেশির ভাগ লোকের মতো ভগবানকে মানা, মন্দিরে যাওয়া, পুজো দেওয়া, সাধুসন্তের কাছে গিয়ে ঢিপঢিপ প্রণাম করা এসব কিছুই করতেন না। যে কারণে ওঁকে অনেকেই এথেয়িস্ট মনে করত। কিন্তু আমি জানি উনি কতখানি পড়াশুনা করেছিলেন আমাদের পুরাণ উপকথা ইত্যাদি এবং শিব পার্বতী রাধা কৃষ্ণ ইত্যাদি কনসেপ্টকে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন, যার জন্যে উনি তাদের রূপ ওইরকম ভিভিডভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন স্টেজের উপরে। উনি পৌরুষ বা পুরুষকারে বিশ্বাস করতেন কিন্তু সেই সঙ্গে একটা শক্তি যে আছে সবকিছুর উপরেই সেটা মানতেন।
ওঁকে আমরা দেখতাম স্টেজে ঢুকবার আগে সাইড উইংস-এ দাড়িয়ে মিনিট খানেক দু’হাত জুড়ে চোখ বুজে কাকে যেন শ্রদ্ধা জানাতেনআমাদের বলেছিলেন উনি নটরাজের মূর্তিকে সামনে রেখে শ্রদ্ধা জানান।
আমার জীবনে আরও কয়েকটি প্রতিভাশালী লোককে আমি শ্রদ্ধা করে এসেছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু দাদা আমার জীবনে এক প্রধান হিরোছিলেন ও চিরদিন থেকে যাবেন।

(উদয়শঙ্করের মৃত্যুর পরে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, আনন্দবাজার পত্রিকায়
প্রকাশিত লেখার নির্বাচিত অংশ। মূল ভাষা ও বানান অবিকৃত।)



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.