পরের দিনই চলে যেতে হবে আমেরিকায়। হাতে সময় নেই বললেই চলে। সারা রাত চলল সুর সৃষ্টি আর রেকর্ডিংয়ের কাজ। বাঁশি, সেতার, সরোদ-সহ অনেক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে এক রাতেই ‘পথের পাঁচালী’-র জন্য সুর দিলেন রবিশঙ্কর।
‘নীচা নগর’ বা ‘ধরতি কে লাল’-এর মতো ছবিতে সুর করা হয়ে গিয়েছে আগেই। কিন্তু অপেক্ষা ছিল ওই একটি রাতের। একটি ‘পথের পাঁচালী’র। তাঁর সেই সুরমূছর্নাই বিশ্বের সেরা ৫০টি ‘ফিল্ম সাউন্ডট্র্যাক’-এর তালিকায় স্থান পায় পরে।
একে অপরের অনুরাগী হলেও ছবির জন্য সঙ্গীত নিজেই তৈরি করতেন সত্যজিৎ রায়। তবে অপু-ট্রিলজি আর পরশ পাথর-এর সুর দিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। সেই সূত্র ধরেই সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর যে যোগাযোগ গড়ে ওঠে, পরেও তা বজায় ছিল বলে জানিয়েছেন সত্যজিৎ-পুত্র, চলচ্চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায়। তাঁর কথায়, “আড্ডাবাজ, মিশুকে মানুষ ছিলেন রবিশঙ্কর। গুরুগম্ভীর বিষয় থেকে হাল্কা হাসির কথাবার্তা কত বিষয়ে কত রকম গল্প যে করতেন! সিনেমা দেখার ঝোঁক ছিল খুব। বিদেশে থাকার দৌলতে অনেক বিদেশি ছবি আগে দেখার সুযোগ পেতেন। এমন কত ছবির হদিস তিনি বাবাকে দিতেন!” |
পথের পাঁচালীর রেকর্ডিংয়ে সৌমেন্দু রায়ের তোলা ছবি। |
সত্যজিতের মৃত্যুর পরে ‘ফেয়ারওয়েল মাই ফ্রেন্ড’ নামে অ্যালবাম তৈরি করেন রবিশঙ্কর। সত্যজিৎও এক সময় ভেবেছিলেন, ওই সেতারশিল্পীকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করবেন। এর জন্য নিজেই রবিশঙ্করের অনেকগুলি স্কেচ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। সন্দীপবাবু বলেন, “হাতে এঁকে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন বাবা। কিন্তু তথ্যচিত্রটা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। হয়তো দু’জনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সেটা আর হয়নি।” সন্দীপবাবুই জানান, বারাণসীতে একটি সঙ্গীত অ্যাকাডেমি করার পরিকল্পনা করেছিলেন রবিশঙ্কর। সেই অ্যাকাডেমি কেমন হবে, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর শ্যুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ, সন্দীপ-সহ অন্যদের তা দেখিয়েছিলেন সেতারশিল্পী।
সন্দীপবাবু এখন চেন্নাইয়ে। সেখান থেকে টেলিফোনে জানালেন, ‘পথের পাঁচালী’ তৈরির স্মৃতি তাঁর খুবই কম। তখন তিনি নেহাতই শিশু। ঝাপসা মনে পড়ে, “রাফ-কাট (অসম্পাদিত) অবস্থায় ‘পথের পাঁচালী’ রবিশঙ্করকে দেখিয়েছিলেন বাবা। ওঁর সেটাই খুব ভাল লেগে যায়।”
সেই ইতিহাসের পাতাই হাতড়াচ্ছিলেন ‘তিন কন্যা’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-সহ সত্যজিতের বহু ছবির সিনেমাটোগ্রাফার সৌমেন্দু রায়। শেষ বিকেলের নিভু নিভু রোদে বসে তিনি ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু কথা শোনাচ্ছিলেন পথের পাঁচালী-র রবিশঙ্কর সম্বন্ধে। জানালেন, এত কম সময়ে ওই সুর তৈরি হয়েছিল যে, ছবির কিছু জায়গার জন্য তখনও রেকর্ডিং হয়নি। সেই দৃশ্যগুলির জন্য পরে সেতার বাজান ওই ছবির সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র। সৌমেন্দুবাবু তখন সুব্রতবাবুর সহযোগী।
একটি নির্বাক ছোট চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ে রবি শঙ্করকে ক্যামেরাবন্দি করার গল্প শোনাচ্ছিলেন রূপকলা কেন্দ্রের উপদেষ্টা, আশি ছুঁইছুঁই সৌমেন্দুবাবু। তাঁর কথায়, “সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনায় ‘টু’-সহ আরো দু’টি ছোট ছবি নিয়ে একটি ট্রিলজি তৈরি হয়েছিল। তারই একটিতে ছিল খাজুরাহোর স্থাপত্যের সঙ্গে রবিশঙ্করের সেতারের আবহ।” ছবিটির কিছু দৃশ্যে রবিশঙ্কর নিজেও ছিলেন। সৌমেন্দুবাবুর কথায়, “মুম্বইয়ের মেহবুব স্টুডিওয় তেমনই একটি দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের আগে রবিশঙ্কর আমাকে নীচের দিক থেকে (লো-অ্যাঙ্গেল) ওঁর ছবি তুলতে বারণ করলেন। কেন জিজ্ঞাসা করায় বলেন, “আমার নাকটা খুব বড়। নীচ থেকে ছবি উঠলে নাকের ফুটোগুলো আরও বড় দেখাবে!”
ছবির ব্যাপারেও এমন সজাগ বলেই হয়তো তিনি বলতে পারতেন, “তোমার ছবির একটা সংগীত-রূপ আমি ভেবে রেখেছি।” যার একটা সুর ভেঁজে শোনাতেই ‘অভিভূত’ হন সত্যজিৎ। তার পর এগারো ঘণ্টা টানা সুর-সৃষ্টির এক পর্ব। মূলত দেশ ও টোড়ি রাগ আশ্রয় করে সে রাতে যে সঙ্গীত তিনি তৈরি করেছিলেন, এখন তা ইতিহাস। কিংবা বলা যায়, সেই সুর রেখে অস্তে গেলেন রবি। |