বিনোদন তাঁর সেতারে সরোদের বোলবাট
মি তাঁকে ‘দাদা’ বলতাম। আমাকে ডাকতেন ‘ভাই’। আমরা যে আসলে একই ঘরানার।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের গুরু উস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং আমার বাবা ও গুরু উস্তাদ হাফিজ আলি খান ছিলেন গুরুভাই। সেই সম্পর্ককে আজীবন সম্মান করে এসেছেন পণ্ডিতজি। তাই আমিও রবিশঙ্করজি-র ভাই, উনি দাদা।
উস্তাদ আলাউদ্দিন এবং আমার বাবা দুজনেই বাজাতেন সরোদ। আমার ঠাকুর্দা উস্তাদ নান্হে খানের মৃত্যুর পরে বাবা রামপুরে চলে যান। সেখানে তানসেন-বংশের মহাগুরু উস্তাদ ওয়াজির খানের কাছে তালিম শুরু হয় তাঁর। অল্পদিন পরে সেই ঘরেই শিক্ষা নিতে যান উস্তাদ আলাউদ্দিন খান। তখন থেকেই ওঁরা গুরুভাই। ‘সেনিয়া বীণকার’ ঘরানা।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার বাদনের বৈশিষ্ট্য বেশ লক্ষ করার মতো। কারণ, তিনি সেতার শিখেছেন সরোদের উস্তাদের কাছে। সে বিষয়ে আলোচনার আগে বলে নিই, তাঁর ‘মাই লাইফ, মাই মিউজিক’ বইতে পণ্ডিতজি লিখেছেন, তিনি প্রথমে উস্তাদ বিলায়েত খানের বাবা উস্তাদ এনায়েত খানের কাছে সেতার শেখার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছে শেষ মুহূর্তে রবিশঙ্করের নাড়া বাঁধা হয় নি। এরপরেই তিনি উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের শিষ্যত্ব নেন।
রবিশঙ্করের সেতার বাদন ছিল প্রাণবন্ত। নিজস্ব ভঙ্গি যুক্ত করে তিনি এতে দিয়েছিলেন আকর্ষণীয় মাত্রা। আর এরই সঙ্গে ছিল রাগ নিয়ে গবেষণা এবং রাগের শুদ্ধতা রক্ষা। সব মিলিয়ে এটাই হয়ে উঠেছে রবিশঙ্কর-স্টাইল।
সরোদের উস্তাদকে গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই রবিশঙ্করের সেতার বাদন হয়ে উঠেছে সরোদ অঙ্গের। সেতারে তিনি এনেছেন সরোদের বোলবাট। ধ্রুপদ এবং বীণকারি দুটি অঙ্গের উপাদানই তাঁর সেতারে ছিল স্পষ্ট। তিনি সেতারে রুদ্রবীণার
লয়কারি সৃষ্টি করতে পারতেন। আর ছিল বিরল তালের ব্যবহার। তাঁর হাতের যন্ত্রে তিনি যুক্ত করেছিলেন দুটি বাড়তি মোটা তারখরজ-পঞ্চম এবং খরজের ‘সা’।
এটা ঠিক, না ভুল সেসব নিয়ে কথা বলার অধিকার জগতে কারও নেই। কারণ, আমি মনে করি, সরোদ বা সেতার কীভাবে বাজানো হবে, তা শুধু ঈশ্বর জানেন। আমি বলার কে! আমি বুঝি, মানুষ সেই বাজনা কীভাবে গ্রহণ করল। সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজনা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে। আমার বিচারে এই হল একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। কেউ হয়তো বলতে পারেন, কারও বাজনা মুষ্টিমেয় বোদ্ধা শ্রোতার জন্য। কেউ বা বলতে পারেন, শিল্পী হিসেবে তিনি তাঁর নিজের তৃপ্তির জন্য বাজান। আমি তা মানি না। নিজের জন্য বাজাতে হলে পাহাড়ের চূড়ায় বা সমুদ্রের ধারে গিয়ে একা একা বাজালেই হয়! এসব কথা তাই অর্থহীন। মানুষ যাঁকে গ্রহণ করে হৃদয়ে স্থান দেয়, তিনিই সার্থক শিল্পী। তা না হলে শিল্পীর সার্থকতা কোথায়? পণ্ডিত রবিশঙ্করকে সারা পৃথিবীতে মানুষ বিপুলভাবে গ্রহণ করেছে। তাই তিনি রবিশঙ্কর। এটাই শেষ কথা।
কোনও রাগ বাজানোর আগে তা নিয়ে তাঁর গবেষণা করার কথা বলেছি। এবার বলি তাঁর রেওয়াজের কথা। যে কোনও কনসার্টের আগে সকালে তবলা নিয়ে পুরোদস্তুর রেওয়াজ করতেন রবিশঙ্কর। নিজের কাজের প্রতি এতটাই নিষ্ঠা ছিল তাঁর যে, ‘স্টেজে উঠে বাজিয়ে দেব’ জাতীয় মনোভাব কখনও প্রশ্রয় দেন নি। বাখ্, বিঠোফেন যেমন ৫০ বার রিহার্সাল দিতেন, পণ্ডিতজিও তেমনই। বিনা রেওয়াজে তিনি মঞ্চে বসতেন না। ইউরোপ, আমেরিকার যা কিছু ভাল, সব অকপটে নিয়েছেন তিনি। তা সে সঙ্গীতই হোক, বা সংস্কৃতি। এটাই তাঁকে দিয়েছে ব্যাপ্তি।
এটা ঠিক যে, পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণ সঙ্গীত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। এক বিরাট শূন্যতা। তবে ভারতে সেতারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে আমি মনে করি না। বহু নবীন প্রতিভা উঠে আসছেন, আসবেন। তাঁরাই আমাদের আগামির আশা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.