অনুষ্ঠানটা পিছোতে হয়েছিল তিন বার। নবতিপর সুরস্রষ্টার শরীর সায় দিচ্ছিল না। চতুর্থ দফায়, সেই তিনিই শাসন করলেন সব অসুস্থতাকে। সেতার হাতে মঞ্চে যখন বসলেন, তখন নাকে বাঁধা অক্সিজেন মাস্ক। সঙ্গে কন্যা অনুষ্কা। ‘৯ দশকব্যাপী এক সঙ্গীতজীবনের চূড়ান্ত উদ্যাপন’ সে দিনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলেছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধরা।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পারফর্মিং আর্ট সেন্টারে গত ৪ নভেম্বরের ওই অনুষ্ঠানেই শেষ বার প্রকাশ্যে বাজিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ঘনিষ্ঠরা বলেন, অনুষ্ঠানের অনুরোধ ফেরাতে চাইতেন না তিনি। চাইতেন না ছুটি।
তবু গত কাল ছুটি হয়েই গেল তাঁর। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোয় ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি সেতারবাদক।
হৃদ্যন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যায় ভুগছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। সম্প্রতি অসুস্থতা বেড়েছিল। লা জোলা-র স্ক্রিপস মেমোরিয়াল হাসপাতালে গত বৃহস্পতিবার তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ভাল্ভ প্রতিস্থাপন হয়। অশক্ত শরীর সেই অস্ত্রোপচারের ধকলটাই আর সামলাতে পারল না। রবিশঙ্করের জীবনাবসান হয় হাসপাতালেই। বিবৃতি দিয়ে সেই খবর জানায় প্রয়াত শিল্পীর পরিবার।
রবিশঙ্করের স্ত্রী সুকন্যা এবং মেয়ে অনুষ্কাশঙ্কর ওই বিবৃতিতে বলেছেন, “অস্ত্রোপচার হয়তো ওঁকে নতুন প্রাণশক্তি দিত। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও শরীর সেই ধকল সামলাতে পারেনি। ওঁর মৃত্যুর সময়ে আমরা পাশে ছিলাম।” অসুস্থতার সময়ে যাঁরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, পাশে থেকেছেন সকলকে ধন্যবাদ দিয়েছেন সুকন্যা-অনুষ্কা। আর বলেছেন, “ওঁকে আমাদের জীবনে পেয়ে আমরা কৃতজ্ঞ। ওঁর সৃষ্টির ধারা বেঁচে থাকবে।”
সেই ধারা বহনের ভার রবিশঙ্কর দিয়ে গেলেন দুই মেয়ে, সেতারশিল্পী অনুষ্কা এবং সঙ্গীতশিল্পী নোরাকে (ওরফে গীতালি)। রইল অনেকগুলি নাতি-নাতনি। রইলেন ছাত্রছাত্রীরা। |
সুরের এ হেন উত্তরাধিকারের সার্থক সমাপতনের এক মুহূর্তে মাত্র ক’দিন আগে উচ্ছ্বসিত শুনিয়েছিল সেতার-সাধককে। যখন তিনি জেনেছিলেন, ৫৫তম গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য বিশ্ব সঙ্গীতের বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তাঁর এবং অনুষ্কার। গর্বিত বাবা বলেছিলেন, “অদ্ভুত লাগছে। আশা করি অনুষ্কাই জিতবে।” আর মেয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, “বাপি মনোনয়ন পেয়েছে! আমি কিছুতেই জিতব না।”
অনুষ্কার ‘বাপি’র ইতিমধ্যেই তিনটি গ্র্যামি রয়েছে। দিদি নোরার গ্র্যামির সংখ্যা বাবার তিনগুণ। কিন্তু এ বার একেবারে বাবা বনাম ছোট মেয়ে! শেষ পর্যন্ত বাবার অ্যালবাম ‘দ্য লিভিং রুম, সেশনস পার্ট ১’ এ বারের গ্র্যামি জেতে, না মেয়ের অ্যালবাম ‘ট্র্যাভেলার’ সেই উত্তর জানতে এখনও অনেক দেরি। ২০১৩-র ১০ ফেব্রুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলেসের স্টেপলস সেন্টারে গ্র্যামি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই সন্ধের অপেক্ষা আর করলেন না রবিশঙ্কর।
যদিও মৃত্যুর ঠিক আগের কয়েকটা দিনে তিনি তৈরি করে গেলেন ওই গ্র্যামি-নাটকের মতোই কিছু অভাবনীয় মুহূর্ত। যার প্রতিক্রিয়া একত্রিশ বছরের অনুষ্কার মতোই ঝাঁকিয়ে দেয় সত্তর ছোঁয়া এক মুম্বইবাসী ‘যুবক’কে।
এ বারের অস্ত্রোপচারের আগের দিন রবিশঙ্কর ফোন করেন অমিতাভ বচ্চনকে। তার পর উত্তেজনায় ফেটে পড়তে পড়তে অমিতাভ ব্লগে লেখেন, “অদ্ভুত ভাবে জীবনে এই প্রথম বার পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাড়ি থেকে ফোন পেলাম। উনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। আগে কয়েক বার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাবাকে চিনতেন। আমিও ওঁর ছেলে-পুত্রবধূকে চিনতাম। কিন্তু এই প্রথম বার এমন একটা ব্যাপার!... ওঁর শরীরটা কিন্তু ভাল নেই। বৃহস্পতিবার অস্ত্রোপচার। বললেন, ওঁর এবং ওঁর স্ত্রীর আমার কাজ ভাল লাগে। উফ্! তার পর আশীর্বাদ করলেন আমাকে!”
সাত সমুদ্র পেরিয়ে এ ভাবেই তাঁর চিঠি পেত তাঁর দেশ, তাঁর শহর। মার্কিন প্রবাসের অবসরে তিনিও শুনেছেন ঘরের ডাক। চলতি বছরের গোড়ায় যখন ভারতে এসেছিলেন, বাজিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে। যদিও ওই শহরে সেটাই যে তাঁর শেষ অনুষ্ঠান, সে কথা লেখা ছিল শিরোনামেই ‘ফেয়ারওয়েল টু বেঙ্গালুরু’। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২। এ দেশের অনুরাগীদের কাছে তখন ঈষৎ অচেনা চেহারা তাঁর। বাজানোর মাঝে মাঝে দাড়িগোঁফের ফাঁকে ঝকঝক করছে হাসি। তার পর আবার সেতারে খেলা করছে প্রবীণ আঙুলগুলো।
বেঙ্গালুরুর ওই কনসার্টের ঠিক তিন বছর আগে শেষ বার বাজিয়েছিলেন কলকাতায়। সে-ও ৭ ফেব্রুয়ারি, সাল ২০০৯। ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, এ বছরের শীতে আরও এক বার আসতে চেয়েছিলেন কলকাতায়। প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন। তাঁর প্রিয় শিল্পীদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও চলছিল। তবে রবিশঙ্কর নিজে ওই অনুষ্ঠানে বাজানোর মতো সুস্থ থাকেন কি না, সেটা নিয়েই ছিল চিন্তা।
তখন কে জানত, এ শহরের সঙ্গে আর দেখাই হবে না তাঁর! |