|
|
|
|
উন্নত জাত ও প্রযুক্তির চাষ |
সাদা ধান চাষে উৎসাহী করছে কৃষি দফতর |
দয়াল সেনগুপ্ত • দুবরাজপুর |
বরাবর স্বর্ণ ধান চাষে অভ্যস্ত বীরভূমের চাষিদের সাদা ধান চাষে আগ্রহী করে তুলতে চাইছে কৃষি দফতর। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অর্থানুকূল্যে একটি নতুন চাষ-ব্যবস্থায় চাষিদের উৎসাহ দিতে শুরু হয়েছে ‘পূর্ব ভারতে সবুজ বিপ্লব আনয়ন’ প্রকল্প। এই কেন্দ্রীয় প্রকল্পে উন্নত বীজ দিয়ে অল্প সময়ে ওই সাদা ধান চাষে উৎসাহিত করছে রাজ্য কৃষি দফতর। ফলন নিয়ে আশঙ্কা না থাকলেও উৎপাদিত ফসলের বাজার নিয়ে চাষিদের সংশয় অবশ্য কাটছে না।
জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এই চাষ ব্যবস্থার জন্য জেলার বিভিন্ন ব্লকে ৩০টি প্রদর্শন ক্ষেত্র গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিটি প্রদর্শন ক্ষেত্রে ২৫০ হেক্টর পরিমাণ জমিতে ‘উন্নত জাত ও প্রযুক্তির চাষ’ হচ্ছে। এ ভাবে কৃষি দফতরের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে জেলার প্রায় ৫৬,২৫০ বিঘা জমিতে চাষিরা এই নতুন ব্যবস্থায় চাষ করছেন। নতুন ব্যবস্থায় চাষিরা আগের তুলনায় অনেক বেশি উপকৃত হবেন বলেই দফতরের দাবি।জেলা কৃষি দফতরের আধিকারিক (বিষয় বিশেষজ্ঞ) পীযূষ বাগদি-র দাবি, “নতুন প্রক্রিয়ায় চাষিরা অনেক উন্নত প্রজাতির বীজ পাচ্ছেন। চাষে প্রয়োজনীয় জল, সারও কম লাগছে। ফলে খরচ ও শ্রমও কমেছে। তা ছাড়া অনেক কম সময়ে চাষ হওয়ায়, রোগে ফসল আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে।”
নতুন পদ্ধতিতে যে বাড়তি সুবিধা হচ্ছে সে কথা মেনে নিচ্ছেন স্থানীয় চাষি ভাসান মণ্ডল, শেখ সইদুলরা। উপকৃত দুই চাষি শেখ মান্নান ও আব্দুল চৌধুরী জানালেন, “শুধু যে ভাল ফলন হয়েছে তা-ই নয়। যে সব জমিতে চাষ করা সম্ভব হবে না বলে আমাদের ধারণা ছিল, সে সব জমিও ফসলে ভরে গিয়েছে!” এ বার যাঁদের সুযোগ হল না, পরের বার এই চাষের কথা ভাবছেন তাঁরাও।
যদিও চাষিদেরই আর একটা অংশ এখনও ঠিক ভরসা পাচ্ছেন না নতুন পদ্ধতিতে। কারণ, এলাকার অধিকাংশ চাষিই বহু বছর ধরে স্বর্ণ প্রজাতির ধান চাষেই অভ্যস্ত। ফলে অন্য প্রজাতির ধান চাষে উৎসাহ দেখান না অনেকেই। তেমনই এলাকার এক চাষি শেখ তড়িৎ চৌধুরী মনে করেন, “বৃষ্টি ঠিক মতো হলে স্বর্ণ-ধান চাষ করাই ভাল। দাম ভাল পাওয়া যায়।” কৃষি দফতর অবশ্য বলছে, দাম মিললেও স্বর্ণ ধান চাষে সমস্যাও অনেক। প্রথমত, ধান চাষে পর্যাপ্ত জলের প্রয়োজন হলেও বর্ষার খামখেয়ালিপনায় অনেক সময়ই ফসল মার খায়। দ্বিতীয়ত, বীজতলা তৈরি করে চারা পুঁতে সেই ফসল তুলতে লেগে যায় ১৫০ দিন। ফলে রবি চাষে সময়ের অভাব হয়। তৃতীয়ত, ফসম ওঠার মুখে বাদামি শোষক পোকার আক্রমণে ক্ষতি হয় ফসলের। তা ছাড়া উঁচু জমি যেখানে সেচের সুবিধা নেই, সেখানে স্বর্ণ ধানের চাষ করা যায় না বলে ওই সব জমি অনাবাদিই থেকে যায়। |
|
মাঠ ভরেছে ফসলে। —নিজস্ব চিত্র। |
নতুন পদ্ধতিতে চাষ করেছেন সগড় গ্রামের শেখ সেলিম ও শেখ রেজাউল। তাঁদের অভিজ্ঞতা আবার চমকপ্রদ। আগামী বছর উন্নত জাত ও প্রযুক্তিতে সাদা ধানের (এমটিইউ-১০১০ বা অন্য উন্নত জাতের ধান কে এই নামেই চেনেন চাষিরা) চাষ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেও দু’জনেরই আশঙ্কা দাম মিলবে তো?
চাষিদের আশঙ্কা যে ভুল নয়, দুবরাজপরেরই দু’টি ধানের আড়ত এবং দু’টি ধানমিলের সঙ্গে কথা টের পাওয়া যাচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আড়তদার বললেন, “প্রথমত কুইন্ট্যাল প্রতি সাদা ধানের দাম ৯৩০-৯৫০ টাকা (স্বর্ণ সেখানে ৯৯০-১০০০ টাকা)। দ্বিতীয়ত, কুইন্ট্যাল প্রতি স্বর্ণ ধান থেকে চাল পাওয়া যায় যেখানে ৬২-৬৪ কেজি, সেখানে সাদা ধান থেকে চাল মেলে ৫৮-৬০ কেজি। তবে চালের মান তুলনায় সাদা ধানে অনেক ভাল এবং দামও অনেক বেশি পাওয়া যায়।” তবুও ধানকল গুলি সাদা ধান নিতে খুব একটা আগ্রহী হয় না বলেই তিনি জানালেন।
কেন?
ধানকল মালিকদের বক্তব্য, সাদা চাল খুব কম উৎপাদন হয় বলে ধানকলেও তা কম আসে। কিন্তু এক এক বারে ৩২ টন ধান ‘ড্রায়ারে’ (ধান খেকে চাল তৈরি করার আগে মেশিনের যে অংশে ধান ঢালা হয়) ঢালতে হয় বলে অল্প জোগানের সাদা ধান নিয়ে লাভ হয় না ধানকলগুলির। তাই চাষিরা দু’ চারবস্তা সাদা ধান নিয়ে এলে সেই ধান স্বর্ণ ধানের সঙ্গে মিশিয়ে ‘ড্রায়ারে’ দিতে হয়। তাই সাদা ধানে এখনও তেমন আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেনি ধানকলগুলি।
কিন্তু আশার কথা, সাদা ধান থেকে তৈরি চালের বাজার দর প্রায় ৩০ টাকা প্রতি কিলো। যেখানে স্বর্ণ ধান থেকে তৈরি প্রতি কিলো চালের বাজার দর মাত্র ১৯ টাকা। তাই ধানকলগুলি মনে করছে, সাদা ধানের চাষ বাড়লে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বেশি দিন লাগবে না। চাষিরা আগের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হবেন।
আনুষঙ্গিক সমস্যা মেটানোর পাশাপাশি নতুন পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের দাম পাওয়ার বিষয়ে চাষিদের আশ্বস্ত করছেন জেলার সহ-কৃষি অধিকর্তা (তথ্য) অমর মণ্ডলও। তাঁর দাবি, “উন্নত বীজে চাষ হবে। ফসলও মিলবে ভাল। তাই দাম না পাওয়ার বিষয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া উৎপাদিত ফসলের মধ্যে দু’টি সরু চাল। বাজারে তার চাহিদা ও দাম দুটোই ভাল।” |
চাষে জল লাগে কম
উঁচু বা পতিত জমিতেও চাষ সম্ভব
চাষে সময় লাগে ১১০-১২০ দিন
ব্যবহৃত বীজ এমটিইউ-১০১০, আইআর-৬৪, আইআর-৩৬ ও এমটিইউ-৭০২৯
প্রতি প্রদর্শন ক্ষেত্রের খরচ ১ লক্ষ ১৮ হাজার টাকা*
*৯০ শতাংশ দেবে কেন্দ্র, বাকি রাজ্য সরকার |
|
|
|
|
|
|