জমিমালিকেরা বলছেন, জমি বিক্রির টাকা এবং চাকরির নিয়োগপত্র হাতে না পেলে তাঁরা কুলটিতে দামাগোড়িয়া-চাপতোড়িয়া খোলামুখ খনি তৈরির কাজ শুরু করতে দেবেন না। ভারত কোকিং কোল লিমিটেড (বিসিসিএল) বলছে, সে সব করতে কয়েক মাস লেগে যাবে। কিন্তু তারা এখনই কাজ শুরু করতে চায়। কোনও পক্ষই পিছু হটতে নারাজ। তবে বিসিসিএল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার আশ্বাস দেওয়ায় বরফ গলতে শুরু করেছে।
মঙ্গলবার দিনভর বৈঠকের পরেও সমাধানসূত্র মেলেনি। বুধবারও সন্ধ্যা পর্যন্ত বিসিসিএলের এরিয়া অফিসে দু’পক্ষের বৈঠক চলে। সংস্থা সূত্রের দাবি, চাকরি যে দেওয়া হচ্ছে তার নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে দশ দিনের মধ্যে চাকরিপ্রার্থীদের ডাক্তারি পরীক্ষার কাজ শেষ করে ফেলা হবে। সেই আশ্বাস শুনে গ্রামবাসী লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে আর বাধা দেওয়া হবে না। স্থানীয় চাপতোড়িয়া জমিহারা কমিটির সভাপতি শুভাশিস মুখোপাধ্যায় জানান, তাঁরা প্রাথমিক ভাবে এই প্রস্তাবে রাজি। তাঁরা চান না, প্রকল্প ভেস্তে যাক। তবে ঘটনার গতিপ্রকৃতির দিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
কুলটির দামাগোড়িয়া সংলগ্ন ছয়টি মৌজায় প্রায় ২২০ একর জমিতে এই খোলামুখ খনির জন্য কয়েক হাজার কোটি টাকা লগ্নি হওয়ার কথা। কর্মসংস্থান হবে কয়েকশো বেকারের। তার মধ্যে জমিদাতা পরিবারের সেই লোকজনও থাকবেন, যাঁদের চাকরি দিতে বিসিসিএল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। |
এই জায়গাতেই খোলমুখ খনি হওয়ার কথা। —নিজস্ব চিত্র। |
সমস্যা হল, ৭০ জনের কাছ থেকে জমি কেনা হলেও তা রেজিস্ট্রি করে জমিমালিকদের দাম মিটিয়ে দেওয়া হয়নি। দু’একর জমি পিছু একটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নিয়োগপত্র হাতে পাননি কেউই। এই পরিস্থিতিতে সোমবার বিসিসিএলের নিয়োগ করা একটি বেসরকারি সংস্থা মাটি খোঁড়ার কাজ শুরু করতে এলে গ্রামবাসী বাধা দেন।
বিসিসিএল সূত্রে জানা গিয়েছে, দামাগোড়িয়া লাগোয়া পড়িরা, লছমনপুর, চাপতোড়িয়া, দেবীপুর, লালবাজার, সবনপুর অঞ্চলে জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। ওই এলাকায় মাটির নীচে অন্তত ২২১ লক্ষ টন কয়লা আছে। চিহ্নিত জমির মালিকেরা স্বেচ্ছাতেই জমি দিয়েছেন। গত মার্চে জমি সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র খনি কর্তৃপক্ষের কাছে জমাও করেছেন তাঁরা। গত ৫ ডিসেম্বর নারকেল ফাটিয়ে প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। অথচ জমি বিক্রির রেজিস্ট্রি হয়নি, জমিদাতারা তাঁদের প্রাপ্য টাকাও পাননি। জমিমালিকেরা সম্ভবত ভাবেননি, এই পরিস্থিতিতে বিসিসিএল ‘তাড়াহুড়ো’ করতে পারে। সে কারণে সোমবার কাজ শুরু চেষ্টা হলে তাঁরা খেপে ওঠেন। এলাকায় ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিসিসিএলের অফিসারেরা ঘটনাস্থলে এলে তাঁদের ঘিরেও বিক্ষোভ দেখানো হয়। জমিহারা কমিটি জানিয়ে দেয়, বিসিসিএল জমি রেজিস্ট্রি করে দাম ও চাকরির নিয়োগপত্র দিলে তবেই তারা কাজ করতে দেবে।
এই জট ছাড়াতে মঙ্গলবার ঝাড়খণ্ডের ধানবাদে সংস্থার সদর কার্যালয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বিসিসিএলের উচ্চপদস্থ কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, জমি রেজিস্ট্রি করে দাম ও নিয়োগপত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে কয়েক মাস লেগে যাবে। তত দিন কাজ শুরু না করে বসে থাকা সম্ভব নয়। তাঁদের ‘বিশ্বাস’ করে কাজ শুরু করতে দিতে হবে। বিসিসিএলের সিএমডি তাপস লাহিড়ি বলেন, “জমিদাতারা চাইলে আমরা কাজ শুরু করতে পারি। না চাইলে আমাদের কিছু করার নেই।” এই অবস্থায় কিছুটা চাপের মুখে পড়ে যাচ্ছেন জমিদাতারাও। কেননা এই প্রকল্পের উপরে গোটা এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নির্ভর করছে। মাত্র ৭০ জন জমিদাতার জন্য তা আটকে গেলে বাকি বাসিন্দারা তা ভাল ভাবে নেবেন না, বলাই বাহুল্য। তা ছাড়া, প্রকল্প এলাকায় যে জমি চলে গিয়েছে তাতে আর চাষাবাদও হবে না। এমনিই পড়ে থাকবে। তাতে আরও লোকসান। বেশ কিছু জমি প্রকল্প এলাকায় পড়েছে, এমন এক স্থানীয় বাসিন্দা অনিল গড়াইয়ের কথায়, “প্রকল্প গুটিয়ে গেলে আমি সব দিক থেকে মারা পড়ব।” ১০ একর জমি গিয়েছে বিক্রমজিৎ মুখোপাধ্যায়ের। তিনি আবার বলেন, “খনি হওয়াটা জরুরি নিশ্চয়ই। কিন্তু চাকরি ও জমির ন্যায্য দাম না পেলে বিপদে পড়ে যাব।” বিসিসিএলের এ দিনের আশ্বাস তাঁদের কিছুটা ভরসা জুগিয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু দ্রুত জমির দাম মেটানো ও চাকরির ব্যবস্থা না হলে যে পরিস্থিতি ফের ঘোরালো হতে পারে, তাতে সন্দেহ নেই। |