বাধাকে পরোয়া করেন না সুদীপ-রিঙ্কু-বদরুদ্দোজা
‘হারকর জিতনে ওয়ালে কো হি বাজিগর কহতে হ্যায়!’
বর্ধমানের রামকৃষ্ণপল্লির সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই ফেললেন, “কথাটা শুনলেই মনে হয়, যেন আমাদের মতো মানুষদের জন্যই বাক্যটা লেখা হয়েছে।” দেড় মাস বয়সে পোলিও কেড়ে নিয়েছে তাঁর ডান পা। কিন্তু দৌড় থামেনি। তাঁর মতো যাঁরা শারীরিক ভাবে দুর্বল, শুধু তাঁদের জন্যই এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে দৌড়ে খুঁজে-খুঁজে তৈরি করছেন প্রতিবন্ধী মানুষের তালিকা। এগিয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত।
নদিয়ার তেহট্টের রিঙ্কু দাস বা বীরভূমের নলহাটির বদরুদ্দোজা শেখও একই গোত্রের মানুষ। নিজেরা প্রতিবন্ধী, সাহায্য করছেন প্রতিবন্ধীদের। রিঙ্কুদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। মাধ্যমিকে দৃষ্টিহীনদের মধ্যে প্রথম হওয়ার পরে সরকারি অনুষ্ঠানে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশেই বিদ্যুৎ পৌঁছয় উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের দেবীনগরের রিঙ্কুর বাড়িতে। কিন্তু ততদিনে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে হতে রিঙ্কুর চোখে নেমে আসে পুরো অন্ধকার। তবুও দৃষ্টিহীনদের সঙ্গে না পড়াশোনা করে আরও কয়েক জন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মতোই ইতিহাসে ভাল নম্বর নিয়ে এমএ পাশ করেন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় প্রথমবারেই সুযোগ পেয়ে যোগ দেন তেহট্টের বিনোদনগর হাইস্কুলে। ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন বাবা। এখন গোটা সংসার, বোনের পড়াশোনা সবই রিঙ্কুর কাঁধে।
রিঙ্কুর কাঁধে ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্বও। মায়ের হাত ধরে ঘোরাফেরা করেন তিনি। সেই ভাবেই ক্লাসরুমে ঢুকতেই হইচই বন্ধ হয়ে যায়। বছর কয়েক আগে খুব সামান্য দেখতে পেতেন।
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় রিঙ্কু দাস বদরুদ্দোজা শেখ
এখন শুধু আলো আর অন্ধকারের ফারাকটা কোনও মতে বুঝতে পারেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের পড়া বুঝতে কোনও সমস্যা হয় না। ছাত্রছাত্রীদের কথায়, ‘‘দিদিমণি এমন ভাবে পড়া বোঝান যেন মনে হয়, আমরা কোনও গল্প শুনছি। ক্লাসেই পড়া মুখস্থ হয়ে যায়।’’ রিঙ্কুর কথায়, “ছাত্রছাত্রীদের মানুষ করে তোলাই আমার ব্রত।”
সেই একই লক্ষ্য নলহাটির বদরুদ্দোজা শেখেরও। বছরভর গ্রামের এঁদো একটা পুকুর আর অঝোর বর্ষায় ক্যানালের খরস্রোতা জলে অর্চনা হেমব্রম ও বিবিয়ানা টুডু নামের দুই প্রতিবন্ধী আদিবাসী তরুণীর অদম্য লড়াই দেখে ‘বদরদা’ ঠিক বুঝে গিয়েছিলেন, শরীর অশক্ত হলেও এই দুই কিশোরীর মনের জোর তাঁরই মতো। কুসুমজলি গ্রামের অর্চনার জন্ম থেকেই ডান হাত ও বাঁ পা অকেজো। বছর দশেক আগে বাবার মৃত্যুর পরে কোনওমতে সংসার চলে। তারই মধ্যে নলহাটি সোফিয়া গার্লস কলেজের বিএ প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। পালস্ পোলিও টিকা না নেওয়া ডহরনাঙ্গি গ্রামের বিবিয়ানার ডান পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই। ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে তাঁরও টানাটানির সংসার। সে-ও ওই কলেজেরই বিএ প্রথম বর্ষের পড়ুয়া।
তাঁদের জীবনটা কিন্তু বদলে দিয়েছেন জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী এবং রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনী সংস্থার বীরভূম জেলা সম্পাদক বদরুদ্দোজা শেখ। দীর্ঘ দিন নিজে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই দুই কিশোরীকে ফ্রি স্টাইল, ব্যাকস্ট্রোক, ব্রেস্টস্ট্রোক ও বাটারফ্লাইয়ে দক্ষ করে তুলেছেন। ইতিমধ্যে এই দুই তরুণী-সহ ‘বদরদা’র আরও অনেক শিষ্য রাজ্য ও জাতীয় স্তরের নানা প্রতিবন্ধী প্রতিযোগিতায় ছিনিয়ে এনেছেন সাফল্য। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসের ঠিক এক দিন আগে রবিবার চেন্নাইয়ের পথে রওনা দিলেন সেই দুই তরুণী। লক্ষ্য, জাতীয় প্যারা অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতা।
সুদীপ বলেন, “রাজ্য জুড়ে কত প্রতিবন্ধী সংগ্রামের জীবন কাটাচ্ছেন, কত জনই বা ধুঁকতে-ধুঁকতে বেঁচে রয়েছেন, তার নিদিষ্ট পরিসংখ্যান তৈরি হয়নি।” রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতর যাঁকে ইতিমধ্যে ‘রোল মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্ধমান-কালনা রোডের পাশে রামকৃষ্ণপল্লির বাড়ি থেকে সুদীপ ওরফে পপিনের দৌড়টা শুরু হয়েছিল অনেক আগে। বাংলায় এমএ আর বিএড করে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি মিলেছিল। পরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে ব্যাঙ্কের চাকরি। তিনি বলেন, “কিন্তু আমি যা চাই, তা করতে গেলে ওই চাকরিটা ছেড়ে দিতেই হত। তাই দিলাম। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দিলাম।”
কী চান সুদীপ? তাঁর জবাব, “সারা জীবন ক্রাচে ভর দিয়ে চলছি। চাই, আমার মতো প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করতে। সফল হওয়ার পথ দেখাতে।”

—নিজস্ব চিত্র



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.