ক্ষোভের চার মুখ
সঙ্কটমোচনের ব্যর্থতায় অস্বস্তি বাড়ছেই তৃণমূলে
সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, কলকাতার শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও শিখা মিত্র, হলদিয়ার শিউলি সাহা তৃণমূলে বিক্ষুব্ধের তালিকা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে! দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন এক এক এলাকার নেতারা। আর এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মরসুমেই বারবার প্রকট হয়ে পড়ছে সঙ্কট সামাল দেওয়ায় তৃণমূলের অদক্ষতা! যার জেরে ক্ষুব্ধ নেতাদের চাপা ক্ষোভ যে কোনও সময় প্রতিবাদের আকারে রাস্তায় নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে শাসক দলেরই অন্দরে।
সঙ্কট সামলাতে ব্যর্থতার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ এই মুহূর্তে শোভনদেব-কাণ্ড। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গী এই বর্ষীয়ান বিধায়ককে বাড়ির অফিস-ঘরে বসিয়ে রেখেও দলনেত্রী যে ভাবে দেখা করেননি, তাতে দলের একাংশ চরম বিস্মিত! স্বভাবতই ক্রুদ্ধ শোভনদেবের অনুগামীরা। দলনেত্রীর সম্মানরক্ষার্থে তাঁরা ঠিক করেছেন, মমতা পুরুলিয়া-বাঁকুড়া সফর সেরে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। তাঁর নিজের কথামতো তৃণমূল নেত্রী যদি কলকাতায় ফিরে শোভনদেবের সঙ্গে কথা বলে মুখ্য সরকারি সচেতকের হেনস্থার ‘বিচার’ করতে উদ্যোগী না হন, তা হলে প্রবীণ ট্রেড ইউনিয়ন নেতার অনুগামীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামবেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে শোভনদেবকে হেনস্থার পরে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজারে’র দায়িত্ব তৃণমূল নেত্রী দিয়েছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। একে তো ক্রাইসিস ম্যানেজাররা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তৃণমূলে কখনওই পান না। তার উপরে তাঁরা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, সংবাদমাধ্যমে কী ভাবে খবর যাচ্ছে, তার ময়না-তদন্তে! এতেই ক্ষোভ বাড়ছে শোভনদেবের অনুগামীদের।
রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় শিখা মিত্র শিউলি সাহা
এমনই এক নেতার কথায়, “দলে শোভনদা’র অসম্মান বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক’দিন আগে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ এনে তাঁর ঘনিষ্ঠ এক তৃণমূল কর্মীকে ফাঁসানোর চেষ্টা হল। যাঁরা এ কাজ করলেন, সত্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁদের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব কোনও ব্যবস্থা নিলেন না। বরং, অরূপ বিশ্বাস তার পরে পূর্ণমন্ত্রী এবং কাউন্সিলর জুঁই বিশ্বাস দক্ষিণ কলকাতা জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভানেত্রী হয়ে পুরস্কার পেয়ে গেলেন!” ওই নেতার প্রশ্ন, “এই কি বিচার? দলনেত্রী এ সব দেখবেন না?” গোটা ঘটনাপ্রবাহ দেখে কংগ্রেসের এক প্রবীণ বিধায়কের মন্তব্য, “শোভনদেব বক্সিংয়ে চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু এখন রেফারির পক্ষপাতিত্বে রিংয়ে কুপোকাত হওয়ার জোগাড়!” দলের নির্দেশ মেনে শোভনদেব আর প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। কিন্তু দলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর অপমানের বিচার না-পেলে তিনিও ছেড়ে দেবেন না। অনুগামীদের তিনি বলেছেন, শেষ দেখে ছাড়বেন!
শোভনদেব-কাণ্ডে তৃণমূলের ক্রাইসিস ম্যানেজারদের অন্যতম পার্থবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন দলেরই বিধায়ক শিখাদেবী। মন্তব্য, পাল্টা মন্তব্যের জেরে দলীয় নেতার বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন কোনও জনপ্রতিনিধি, এই রকম ঘটনা সাম্প্রতিক কালে রাজ্য রাজনীতি দেখেনি! শিখাদবী যে হেতু আবার সাংসদ সোমেন মিত্রের স্ত্রী, তাই এই ঘটনায় গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্যও দেখছে তৃণমূল শিবিরের একাংশ।
এরই মধ্যে তৃণমূলের অস্বস্তি বহাল রেখেছেন সিঙ্গুরের বিধায়ক রবীন্দ্রনাথবাবু। শনিবার তিনি বলেছিলেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে দল শাস্তি দিলে মাথা পেতে নেবেন। কিন্তু রবিবার ঈষৎ সুর চড়িয়ে তিনি বলেছেন, “ভুল আলাদা। অন্যায় আলাদা। সুপ্রিমো (মমতা) বলতেই পারেন, আমি শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছি। যা করেছি, অবগত হয়েই করেছি। তার অর্থ এই নয় যে, অন্যায় করেছি!” শারীরিক অক্ষমতার জন্য মন্ত্রিত্বের পরে বিধায়ক-পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনৈতিক অবসরের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রয়েছে জানিয়েও রবীন্দ্রনাথবাবু এ দিন মন্তব্য করেছেন, “মমতার কাছে যাব না। নতুন করে কিছু জানানোর নেই। মমতার তরফেও যোগাযোগ করা হয়নি। রাজ্য নেতারাও কেউ যোগাযোগ করেননি।”
দলের ভিতরে-বাইরে সার্বিক ভাবে যে মানসিক সমর্থন ও সহমর্মিতা শোভনদেববাবু পাচ্ছেন, প্রবীণ রবীন্দ্রবাবুর জন্য অবশ্য তা নেই। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “মাস্টারমশাই গত ৪৮ ঘণ্টাতেই নানা রকম কথা বলেছেন। শুক্রবার বলেছিলেন, কোনও অভিমান নেই। রাজনৈতিক সন্ন্যাস নিতে চান। শনিবার বললেন, দল শাস্তি দিলে মাথা পেতে নেবেন। রবিবার বলছেন, অন্যায় করেননি! তা ছাড়া, যিনি রাজনৈতিক সন্ন্যাসে ইচ্ছুক, কারও যোগাযোগ করার প্রত্যাশা তাঁর থাকবে কেন?”
তৃণমূলের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে এ দিনই পূর্ব মেদিনীপুরের সুতাহাটায় তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষা সেলের ‘নবীন শিক্ষক বরণ’ অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন হলদিয়ার বিধায়ক শিউলি। শনিবার তমলুকে দলের নির্বাচনী প্রস্তুতি সভায় শিউলি ডাক না-পাওয়ার পরের দিনই এই ঘটনা নতুন চাপানউতোরের জন্ম দিয়েছে। সুতাহাটা লাবণ্যপ্রভা বালিকা বিদ্যালয়ে এ দিন হলদিয়া, সুতাহাটা উত্তর ও দক্ষিণ চক্রে নব নিযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের বরণ করতে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল তৃণমূল শিক্ষা সেল। মুখ্য আমন্ত্রিত ছিলেন তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। ছিলেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ চেয়ারম্যান তথা শিক্ষা সেলের জেলা সভাপতি গোপাল সাহু, শিক্ষা সেলের হলদিয়া মহকুমা আহ্বায়ক রঞ্জিত দাস ও স্থানীয় কাউন্সিলররাও। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের বাছাই কমিটির সদস্য শিউলিদেবী সেখানে ছিলেন না। তাঁর অভিযোগ, “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই আমাকে ওই অনুষ্ঠানের কথা জানানো হয়নি।”
যোগাযোগ করা হলে কোনও মন্তব্য করতে চাননি শুভেন্দু। তৃণমূল শিক্ষা সেলের জেলা সভাপতি গোপালবাবু বলেন, “বিধায়ককে ডাকা উচিত ছিল। তবে উনি যদি ডাক না-পেয়ে থাকেন, তবে তা কেন হল ওঁকেও ভাবতে হবে!”
শিক্ষা সেলের হলদিয়ার মহকুমা আহ্বায়ক রঞ্জিতবাবুর দাবি, “যাঁরা আমন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা গিয়ে ওঁকে পাননি। উনি তো অধিকাংশ দিনই হলদিয়ায় থাকেন না।” শিউলি অবশ্য বলেন, “এ সব অজুহাত! আমি না-থাকলেও অফিস খোলা থাকে।”
সঙ্কট-পর্বে আপাতত যবনিকা নেই তৃণমূলে!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.