একই বাস। ভাড়া হবে দু’রকম। কারণ, বেসরকারি বাসের যাত্রী-ভাড়া আর বাড়াতে রাজ্য নারাজ হলেও ওই বাসই বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দিয়ে বেশি ভাড়ায় চালানোর ভাবনা-চিন্তা চলছে প্রশাসনে।
বাস চালানোর জন্য পর পর দু’বার বিজ্ঞাপন দিয়েও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর তরফে তেমন সাড়া মেলেনি। বর্তমান ভাড়া- কাঠামোয় বাস চালাতে অধিকাংশ সংস্থা আগ্রহী নয়। উপরন্তু ভাড়া নির্ধারণের রাশ সরকারের হাতে থাকুক, এতেও তাদের আপত্তি। এই পরিস্থিতিতে কর্পোরেট সংস্থার আগ্রহ আকর্ষণের লক্ষ্যে সরকার ভাড়া-প্রশ্নে কিছুটা নরম হতে চলেছে বলে পরিবহণ-সূত্রের ইঙ্গিত। সূত্রের দাবি, চলতি সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে রাজ্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কর্পোরেট সংস্থাকে যে ধরনের বাস চালাতে বলা হচ্ছে, জেএনএনইউআরএম প্রকল্পের মাধ্যমে পাওয়া সেই সব বাস বেসরকারি মালিকেরাও পথে নামিয়েছেন। সাধারণ বাসের চেয়ে এগুলো উন্নতমানের, যদিও ভাড়া সাধারণ বাসের মতো। ভাড়া-বিতর্কের জেরে ইদানীং পথে বেসরকারি বাসের
সংখ্যা এমনিতেই যথেষ্ট কমেছে। তার মধ্যে জেএনএনইউআরএমের বাস কমেছে সবচেয়ে বেশি। এত কম ভাড়ায় খরচা পোষানো অসম্ভব বলেই বাস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে বলে মালিকমহলের দাবি।
এবং এখন ওই বাসই কর্পোরেট সংস্থাকে দিয়ে বেশি ভাড়ায়
চালানোর যৌক্তিকতা সম্পর্কে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সরকার কী বলছে? |
মহাকরণের এক কর্তার ব্যাখ্যা, “সাধারণ বাস-মালিক আর কর্পোরেট কোম্পানি এক নয়। এক-একটা কর্পোরেট সংস্থা এক সঙ্গে অন্তত পঞ্চাশটা বাস চালাবে। তাই তাদের নিজেদের ওয়ার্কশপ, গ্যারাজ ইত্যাদি রাখতে হবে। ওই রক্ষণাবেক্ষণের পিছনে খরচ আছে। এটা মাথায় রেখেই সরকার কর্পোরেটদের ক্ষেত্রে সামান্য হলেও ভাড়া বাড়ানোর কথা ভাবছে।”
বিষয়টিতে এখনও মুখ্যমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি বলে জানিয়েছেন ওই কর্তা। কিন্তু পরিকল্পনাটির আঁচ পেয়ে বেসরকারি বাস-মালিকদের একাংশ রীতিমতো ক্ষুব্ধ। সরকারের এ হেন মনোভাবকে আদতে ‘বেসরকারি বাস-শিল্পকে ধ্বংস করার ফন্দি’ হিসেবে দেখছেন ওঁরা। বাস-মালিক সংগঠন ‘বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট’-এর দীপক সরকারের প্রশ্ন, “যদি কর্পোরেটের ক্ষেত্রে ভাড়া বেশি রাখা যায়, তা হলে আমাদের ক্ষেত্রে নয় কেন? আমরা তো ভাড়া বিস্তর বাড়াতে বলছি না!” পরিবহণ দফতরের একাধিক কর্তার পাল্টা যুক্তি: ভাড়া যতই বাড়ুক, বর্তমান মালিকেরা যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর দেন না, যা কর্পোরেট সংস্থাগুলোর কাছে পাওয়া যাবে। “ভাঙাচোরা বাস নয়, তখন শহর জুড়ে চলবে ঝাঁ চকচকে বাস। তাতে চড়ে যাত্রীরা অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন।” মন্তব্য এক পরিবহণ-কর্তার।
বাস-মালিকদের অনেকের মতে, সরকারের এই যুক্তি অবাস্তব ও অভিসন্ধিপ্রসূত। মালিকদের অন্য সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট’-এর তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য আমরাও দিতে পারি। ঝাঁ চকচকে বাস হাজির করতে পারি। কিন্তু সে জন্য ভাড়া যা করা দরকার, সেটা তো সরকার
করছে না! উল্টে আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে।”
সংগঠন-সূত্রের খবর: বাম জমানার শেষাশেষি জেএনএনইউআরএমের যে সব বাস নিয়ে বেসরকারি মালিকেরা বিভিন্ন রুটে নামিয়েছিলেন, ভাড়া-আদায়ের ঘাটতিতে তার সিংহভাগ এখন বসে গিয়েছে। “জেএনএনইউআরএমের বাসগুলো উন্নতমানের। তার পিছনে খরচও বেশি। এত কম ভাড়ায় ওই সব বাসের রক্ষণাবেক্ষণ চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। তাই অর্ধেকের বেশি বসে গিয়েছে।” বলেন তপনবাবু। মালিক সংগঠনের অভিযোগ: বাস রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি-ব্যয়ের পাশাপাশি
পুলিশের জরিমানা, বিমার খরচও বেড়েছে। অথচ ভাড়া উঠছে না। অতএব, বাস বসিয়ে রাখা ছাড়া উপায় থাকছে না। শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে জয়েন্ট কাউন্সিল। তপনবাবুর কথায়, “আমরা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছি, সব খরচ মিটিয়ে আমরা নতুন বাসের কিস্তি শুধতে পারছি না। তাই বাসগুলো বসে যাচ্ছে।”
বস্তুত যাত্রী-ভাড়া না-বাড়ালে কর্পোরেট সংস্থাও যে বাস চালাতে আসবে না, পরিবহণ দফতরের কর্তারা তা বুঝছেন। একই সঙ্গে ভাড়া-হার নিয়ন্ত্রণও কি কর্পোরেটের হাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে?
সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন মন্ত্রী মদনবাবু। তাঁর বক্তব্য, “আলোচনা হচ্ছে। এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।”
মন্ত্রী মুখ না-খুললেও সিপিএম-প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠন সিটু মনে করছে, এটা পরিকল্পিত ভাবে সাধারণ বাস তুলে দিয়ে বেশি ভাড়ায় কর্পোরেট বাস চালানোর ‘সরকারি চক্রান্ত’ ছাড়া কিছু নয়।
সিটু নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলছেন, “আমরা অনেক দিন যাবৎ এই চক্রান্তের কথা বলে আসছি। বর্তমান সরকার সমস্ত পরিবহণ
ব্যবস্থা কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চাইছে। এখনই ওরা সবটা ভাঙছে না। কৌশলে এগোচ্ছে।” |