চোখে ক্ষীণদৃষ্টি, তবুও স্কুলে হাজিরা নব্বই শতাংশেরও বেশি। লিখতে কষ্ট হয়, তাই অস্বাভাবিক স্মরণশক্তিতে ভর করেই শিক্ষকদের পড়ানো রপ্ত করে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সুকিতা মণ্ডল। পরিবারের চিন্তা এরপর কি হবে? হাই স্কুলে গিয়ে এভাবে পড়াশোনা চালাতে পারবে তো? তাই লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছে অপূর্ণ রেখেই এবছরই পড়াশোনা বন্ধ হতে চলেছে সুকিতার।
রঘুনাথগঞ্জ-১ ব্লকের জামুয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বছর দশেকের সুকিতা চোখে ঝাপসা দেখে। চোখের মণি দুটো এমনই যাতে ডান দিকে তাকালে তার নজরে পড়ে বাম দিকের জিনিস। জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ শঙ্করলাল সাহা বলেন, ‘এক্ষেত্রে রেটিনার সমস্যা। জন্মগত ছানিও রয়েছে চোখে। ফলে ট্যারা দেখায় এবং চোখে অস্পষ্ট দৃষ্টি। উপযুক্ত চিকিৎসায় কেটে যেতে পারে তার এই ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা।’’ |
দিনমজুর বাবার বড় মেয়ে সুকিতা ক্ষীণদৃষ্টি নিয়েই বাড়ির কাজ করে, স্কুলের শ্রেণীকক্ষ সাফাই করে আর পাঁচজন ছাত্রছাত্রীর মতোই। মা চিন্তা মণ্ডল বলেন, ‘‘মেয়েকে নিয়ে একাধিকবার সরকারি হাসপাতালে গিয়েছি। দেখিয়েছি বিভিন্ন চক্ষু অপারেশন শিবিরে। চিকিৎসকেরা সকলেই পরামর্শ দিয়েছেন কলকাতার বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করলেই সেরে যাবে সমস্যা। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতির অভাবেই শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি।’’ মায়ের কথায়, ‘‘চোখে দেখে না কিন্তু অসম্ভব স্মরণশক্তি ওর। যে কোনও কথা একবার শুনেই স্মরণে রাখতে পারে। ঘরের কাজ সামলে স্নান সেরে স্কুলে যাওয়া নিত্যদিনের অভ্যাস সুকিতার। কোনওদিন স্কুলে যেতে বাধা দিলে মেয়ে কেঁদে আকুল।’’
প্রধানশিক্ষক প্রবীর পাল বলেন, ‘‘অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর তুলনায় সুকিতার স্কুলে হাজিরা নজরকাড়ার মতো। ক্ষীণদৃষ্টি বলে ক্লাসের প্রথম দিকে বসে সে। শিক্ষকদের বলা হয়েছে ক্লাসে মুখে উচ্চারণ করে পড়াবেন সেটা শুনে শুনেই মনে রাখে এবং পরীক্ষা দেয় সুকিতা।’’
স্কুলেরই শিক্ষক রাজীব মণ্ডল বলেন, ‘‘সুকিতার স্মরণশক্তি দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। এলাকার চক্ষু চিকিৎসদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বারকয়েক। তাঁরা অপারেশনের পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু আর্থিক দুরাবস্থার কারণে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। স্কুলেরও তেমন কোনও ফান্ড নেই যা দিয়ে তার চিকিৎসা সম্ভব। তাই পঞ্চায়েত ও সর্বশিক্ষা মিশনে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’’
কি বলছে সুকিতা? ‘‘এবার প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডী পেরবো। এতদিন শুনে শুনে পড়েছি। কিন্তু হাই স্কুলে তো আর সম্ভব নয়। তাই হয়ত এখানেই পড়াশোনার ইতি পড়বে।’’ অশ্রুসজল চোখে সুকিতা বলে, ‘‘একদিন চোখে দেখতে পাব, এই ভরসায় দিন গুনছি।’’ |