|
|
|
|
বেচারামের কাঠগড়ায় বিচারক |
হাইকোর্টের সিঙ্গুর রায়কে কটাক্ষ করে বিতর্কে মন্ত্রী |
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় • সিঙ্গুর |
দু’দিন আগে সিঙ্গুরে এসে যে বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তাকেই আরও ঘোরালো করে তুললেন রাজ্য মন্ত্রিসভায় তাঁর নবীন সহকর্মী বেচারাম মান্না!
|
বেচারাম মান্না |
সিঙ্গুরে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, আদালতে মামলা মিটলেই টাটার কারখানার জন্য অধিগৃহীত জমি অনিচ্ছুক কৃষকের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আদালতের বিচারাধীন বিষয়ের পরিণতি ধরে নিয়ে কী ভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমন মন্তব্য করতে পারেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এ বার আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম রবিবার প্রকাশ্য সভায় অভিযোগ করলেন, “টাটা এবং সিপিএম একজোট হয়ে এবং তাদের অনুগত বিচারক দিয়ে হাইকোর্টে আমাদের হারিয়ে দিয়েছে!” যে কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে মমতারই এক মন্তব্যকে। বিধানসভার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, টাকা দিয়ে রায় কেনা যায়! তাঁর সেই মন্তব্যকে আদালতের পক্ষে অবমাননাকর বলে অভিযোগ তুলে মামলাও হয়েছে। |
|
ক্রমেই কি পাতলা হচ্ছে ভিড়? রবিবার সিঙ্গুরের সভায়। —নিজস্ব চিত্র |
সিঙ্গুরের জমি-সমস্যা না মেটায় অনিচ্ছুকদের ক্ষোভ যত বাড়ছে, ততই চাপ বাড়ছে মমতার সরকারের উপরে। রাজ্যের মন্ত্রী এবং তৃণমূল নেতাদের একের পর মন্তব্যে সরকারের সেই দিশাহীনতাই প্রকট হয়ে উঠছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক শিবিরের একাংশ। সম্প্রতি মমতাও সিঙ্গুরে আসার আগে বলেন, বার্তা দেবেন। কার্যক্ষেত্রে নতুন কিছুই পাননি অনিচ্ছুকরা, শুধু মামলা মিটলে জমি ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাসটুকু ছাড়া। এ দিন মন্ত্রী বেচারামবাবুর মন্তব্য সেই দিশাহীনতারই আর এক নিদর্শন বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁর এ দিনের বক্তৃতা সম্পর্কে রাজনীতির কারবারিদের বক্তব্য, জমি ফেরাতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতেই এ সব বলছেন ওঁরা। সেটা করতে গিয়ে নতুন করে বিতর্কে জড়িয়েছেন বেচারাম। যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাম-কংগ্রেস-বিজেপি-সহ সব বিরোধী। তাঁদের জিজ্ঞাসা, মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিয়ে মন্ত্রী হয়ে কি এমন কথা বলা যায়? আইনজীবী মহলের একাংশ মনে করছে, এর ফলে বেচারামবাবু আদালত অবমাননার দায়ে পড়তে পারেন। অনেকে আবার এ-ও বলছেন, ব্যর্থতা ঢাকতে গিয়ে কি আগুন নিয়ে খেলছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? টাটা মোটরসের এক মুখপাত্র অবশ্য এ দিন জানান, এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না।
দেড় বছর আগে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে মমতা-মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্তই ছিল অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দেওয়া। সে জন্য প্রয়োজনীয় আইনও তৈরি হয়। সেই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে টাটা মোটরস হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। চলতি বছরের মাঝামাঝি হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সেই আইনকে অসাংবিধানিক এবং অবৈধ বলে রায় দেওয়ায় রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। সেই মামলা এখনও চলছে।
ছ’বছর আগে এই দিনে সিঙ্গুরে চাষিদের উপরে লাঠি-গ্যাস-রবার বুলেট চালিয়েছিল পুলিশ। তার প্রতিবাদে প্রতি বছর ২ ডিসেম্বর সিঙ্গুর দিবস পালন করে তৃণমূল নেতৃত্বাধীন ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’। এ দিন সেই উপলক্ষেই বেড়াবেড়ি বাজারে সভা হয়। সভামঞ্চকে কাজে লাগিয়ে বেচাবাবুরা মরিয়া হয়ে সিঙ্গুরের ক্ষোভ দূর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হল উল্টো। একে তো বিতর্কিত কথা বলে নিজে সমস্যায় পড়লেন বেচারাম। অন্য দিকে, আবার আন্দোলনের কথা শুনে ক্ষুব্ধ সিঙ্গুর জানিয়ে দিল, হয় জমি চাই, নয় টাকা।
|
আইন সম্পর্কে অশিক্ষিত লোককে মমতা যদি মন্ত্রী করেন,
তা হলে ওঁকে অশেষ দুর্গতিতে পড়তে হবে।
অরুণাভ ঘোষ
কংগ্রেস নেতা
|
মুখ্যমন্ত্রী কিছু দিন আগে বিচার ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করেছিলেন।
তাঁর দলের আর এক জনও করবেন, এ আর বেশি কী!
রাহুল সিন্হা
বিজেপি সভাপতি |
বেচারাম মান্না যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার যোগ্য
সদস্য, খুব দ্রুত তার প্রমাণ দিচ্ছেন।
মহম্মদ সেলিম
সিপিএম নেতা |
টাটা এবং সিপিএম এক জোট হয়ে এবং তাদের অনুগত
বিচারক দিয়ে হাইকোর্টে আমাদের হারিয়ে দিয়েছে।
বেচারাম মান্না
কৃষি প্রতিমন্ত্রী |
|
সব থেকে চোখে পড়ার মতো ঘটনা, এ দিন সভার লোকসংখ্যা। হাতে গোনা কিছু মানুষের সামনে বক্তব্য রাখলেন নতুন কৃষি প্রতিমন্ত্রী। সিঙ্গুরে গত ছ’বছরের মধ্যে কখনও এমন জনবিরল সভা করেনি তৃণমূল।
সভায় কী বললেন বেচারাম? বললেন, “জমি ফেরত দেওয়ার বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। আদালতকে মান্যতা দিতেই আমরা জমি দখল করে চাষ করতে যাচ্ছি না। টাটা এবং সিপিএম একজোট হয়ে এবং তাদের অনুগত বিচারক দিয়ে হাইকোর্টে আমাদের হারিয়ে দিয়েছে। এখন পুরো বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে।” সেই সঙ্গে সিঙ্গুরের কৃষকদের প্রতি মন্ত্রীর আশ্বাস, “আপনারা ধৈর্য ধরুন। জানুয়ারি মাসের মধ্যেই হয়তো একটা কিছু হবে। যেটা চাষিদের পক্ষে যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।”
কিন্তু সেই রায় যদি রাজ্য সরকারের বিপক্ষে যায়? বস্তুত, সেই ইঙ্গিতও ছিল বেচার কথায়। তিনি বলেন, “রায় বিপক্ষে গেলে আন্দোলনই শেষ কথা বলবে।” একই সঙ্গে তাঁর হুঁশিয়ারি, “তা হলে সিঙ্গুরের মানুষ মাঠে নেমে নতুন আইন রচনা করবে।” যার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী শিবির প্রশ্ন তুলেছে, এ কীসের হুঁশিয়ারি? তা ছাড়া, এখন তো তৃণমূলেরই সরকার। তারা আন্দোলন করবে কার বিরুদ্ধে?
একই প্রশ্ন সিঙ্গুরবাসীর মুখেও। এবং তাঁদের সাফ কথা, অনেক হয়েছে, আর না! গোপালনগর মধ্যপাড়ার জিতেন ঘোষের বক্তব্য, “আন্দোলন অনেক হয়েছে। আর পারছি না।” ঘোষপাড়ার সমাপ্তি ঘোষের কথায়, “এখন জমির টাকা পেয়ে গেলে বেঁচে যাই!” যতই বেচাবাবু বলুন, ‘কথা দিচ্ছি, যত ক্ষণ না জমি ফেরত দিতে পারব, আপনাদের পাশে আছি। আস্থা রাখুন,’ যতই আগামী ১৮ ডিসেম্বর তাপসী মালিকের মৃত্যুদিবসে পথসভা-মিছিল করার কথা ঘোষণা করুন, ভরসা রাখতে পারছেন না অনিচ্ছুকরা। বাজেমিলিয়ার বাদল সাঁতরা বলেই দিয়েছেন, “আর ভরসা দেখছি না ও সব আন্দোলনে।” উত্তর বাজেমিলিয়ার সনৎ ঘোষ বলেন, “দিদির দেড় বছর ক্ষমতায় থাকা হয়ে গেল। এখন আবার আদালত দেখাচ্ছে! ও সব আন্দোলনে আমরা আর নেই।”
বেচারামবাবু এ দিন সংবাদমাধ্যমকেও কাঠগড়ায় তোলেন। বলেন, “বুধবার ব্লক অফিসে কুপন বিলি ঘিরে কোনও ক্ষোভ ছিল না। সে দিন প্রায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আমি লাইন নিয়ন্ত্রণ করি। সে দিনের গোলমালের পুরোটাই সংবাদমাধ্যমের সৃষ্টি।” তার পরেই তাঁর হুঁশিয়ারি, “যে সব টিভি চ্যানেল এই অপপ্রচার করছে, তাদের দরকার হলে গ্রামে ঢুকতে দেবেন না!” একই সঙ্গে মন্ত্রীর সংযোজন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি নাকি ১৭ কোটি টাকার মালিক। এটা সত্যি নয়।”
ঘটনাচক্রে, সিঙ্গুরের তৃণমূল বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সিঙ্গুর-জট সম্পর্কে বলেছেন, টাটা-রাজ্য সরকার-চাষিদের নিয়ে আলোচনায় সমাধানসূত্র বেরোতে পারত। তবে একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “টাটাদের সম্পর্কে মমতার মতো ব্যক্তিত্বকে উপদেশ দেওয়া উচিত নয়। বিষয়টি বিচারাধীনও।”
এক কংগ্রেসি নেতার মন্তব্য, “তৃণমূলেই এখন নানা মুনির নানা মত! সিঙ্গুরবাসীই বিচার করবেন!” |
|
|
|
|
|