পড়ুয়াদের জন্য বাড়িতে সব সময়েই মজুত থাকে খাতা পেন। কোনও পড়ুয়া কিনতে না পারলে তাদের হাতে খাতা কলম তুলে দেন ‘স্যার’।
তিনি সত্যহরি ঘোষ। বর্ধমানের মঙ্গলকোটের খেঁড়ুয়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় বাড়ি। দেড় বছর বয়স থেকে পিঠে কুঁজ নিয়ে বড় হয়েছেন। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে কাটোয়ার কেডিআইতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৯২-এ স্নাতক হন কাটোয়া কলেজ থেকে।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল সবই। কিন্তু ক্রমশ পা দু’টো যেন বিদ্রোহ করতে শুরু করল। কিছুটা হাঁটার পরেই পড়ে যেতেন রাস্তায়। স্নায়ুর চিকিৎসা থেকে কী করেননি! লাভ হয়নি কোনও। ১৯৯৭য়ের পর তাঁর পা দু’টো কার্যত অসাড় হয়ে পড়েছে। এখন দেওয়াল ধরে হাঁটেন বছর চল্লিশের ওই যুবক।
গৃহশিক্ষকতা করেই সময় কাটে সত্যহরিবাবুর। পড়ুয়াদের বেশিরভাগই অবশ্য বেতন দিতে পারে না। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের পড়ান তিনি। দিনে তিনটি করে ব্যাচ। ওই গ্রাম ছাড়াও পাশের শ্যামবাজার, কোঁয়ারপুর, সাঁড়ি ও ব্রহ্মপুরের পড়ুয়ারাও চলে আসে তাঁর কাছে পড়তে। গ্রামের বাসিন্দা পাঁচকড়ি ঘোষ বলেন, “সত্যহরি আমাদের ‘মুসকিল আসান’। ওঁর জন্যই আমাদের মতো ঘরের ছেলেরা বইমুখো হয়েছে।” কাকলি ঘোষ, মৌসুমী দাস, চিন্ময় দাসের মতো পড়ুয়ারা বলেন, “স্যার আমাদের জন্য খাতা পেন কিনে রেখে দেন। কারওর কিনতে দেরি হলে স্যার তাদের খাতা পেন দেন।” |
জ্ঞানদা কর্মকার নামে এক অভিভাবকের বক্তব্য, “আমার এক ছেলে মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়ে। এর আগে দুই মেয়েও ওঁর কাছে পড়েছে। কিছু দিতে পারিনি ওঁকে।” আর এক অভিভাবক কালু দাসের বক্তব্য, “বেতন না পেলেও পড়ুয়াদের পাঠানোর জন্য আমাদের বলেন মাস্টারমশাই।” বাসিন্দাদেরও বক্তব্য, কেউ পড়া ছেড়ে দিচ্ছে খবর পেলে মাস্টারমশাই তাদের বুঝিয়ে স্কুলে ফেরানোর চেষ্টা করেন।”
শুধু পড়ানো নয়, গ্রামে রক্তদান শিবির বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, তাঁর ডাক পড়ে সর্বত্র। তাঁকে ছাড়া গ্রামে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন কার্যত অসম্ভব। গ্রামের শিক্ষক দেবপ্রসাদ বাগ বলেন, দেবকুমার ধারা বলেন, “চিকিৎসার ব্যাপারেও মাস্টারমশাই খুব সাহায্য করেন।” এখনও পর্যন্ত অবশ্য প্রতিবন্ধী সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে পারেননি সত্যহরিবাবু। তাঁর কথায়, “বাবা-দাদারা খুব কষ্ট করে পড়িয়েছেন আমাকে। তাই কারওর কাছে টাকা চাই না। আমার ছাত্ররা পড়াশোনা করে মানুষ হোক, এটাই চাই।” সত্যহরিবাবুর মা রসময়ীদেবী বলেন, “পড়ুয়ারা ও তাদের অভিভাবকেরা যে সম্মান ও ভালবাসা ওকে দেয়, তা টাকাপয়সার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।” মঙ্গলকোটের সুশান্তকুমার মণ্ডলের অবশ্য বক্তব্য, উনি কেন প্রতিবন্ধী সরঞ্জাম পাননি খতিয়ে দেখব। |