মাত্র দেড় মাস বয়সে পোলিও কেড়ে নিয়েছিল ডান পা।
কিন্তু দৌড় থামাতে পারেনি। তাঁর মতো যাঁরা শারীরিক ভাবে দুর্বল, শুধু তাঁদের জন্যই এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। খুঁজে-খুঁজে তৈরি করছেন প্রতিবন্ধী মানুষের তালিকা। এগিয়ে দিচ্ছেন সাহায্যের হাত।
“রাজ্য জুড়ে কত জন প্রতিবন্ধী সংগ্রামের জীবন কাটাচ্ছেন, কত জনই বা ধুঁকতে-ধুঁকতে বেঁচে আছেন, তার নিদিষ্ট পরিসংখ্যান তৈরি হয়নি” বলছেন সুদীপ। রাজ্যের সমাজকল্যাণ দফতর যাঁকে ইতিমধ্যে ‘রোল মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বর্ধমান-কালনা রোডের পাশে রামকৃষ্ণপল্লির বাড়ি থেকে সুদীপ ওরফে পপিনের দৌড়টা শুরু হয়েছিল অনেক আগে। বাংলায় এমএ আর বিএড করে প্রাথমিক স্কুলে চাকরি মিলেছিল। পরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে ব্যাঙ্কের চাকরি জোটে। “কিন্তু আমি যা চাই, তা করতে গেলে ওই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দিলাম।”
|
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
—নিজস্ব চিত্র। |
কী চান সুদীপ?
“সারা জীবন ক্রাচে ভর দিয়ে চলছি। একটাই জিনিস চাই, আমার মতো প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করতে। সফল হওয়ার পথ দেখাতে।”
তাই চাকরি করতে-করতেই একটি প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা খুলেছেন সুদীপ। লক্ষ্য, প্রতিবন্ধীদের রুজির পথ দেখানো। তাঁর অভিযোগ, “জেলায়-জেলায় প্রতিবন্ধীদের জন্য তেমন কার্যকর সরকারি প্রকল্প নেই। প্রতিবন্ধী চিহ্নিতকরণের কাজও সে ভাবে হচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন দফতরে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংরক্ষণ মেনে কাজও দেওয়া হচ্ছে না।” তিনি মনে করিয়ে দেন, এক জায়গায় বসে করা যায় এমন কাজ বেশির ভাগ প্রতিবন্ধীই ভাল করতে পারেন। কিন্তু বিগত সরকারের যেমন নজর ছিল না, এই সরকারেরও সে দিকে নজর নেই আক্ষেপ তাঁর।
বসে-বসে শুধু আক্ষেপ করার মানুষ অবশ্য সুদীপ নন। বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে নিজেই তিনি তৈরি করছেন প্রতিবন্ধীদের তালিকা। তা জমা দিচ্ছেন জেলা সমাজকল্যাণ দফতরে। কী ভাবে তাঁদের পুনর্বাসন সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছেন। বিভিন্ন ব্যাঙ্কে বা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে-ঘুরে সহযোগিতা চাইছেন। যাতে হুইল চেয়ার বা চলাফেরার সরঞ্জাম জোগাড় করে দেওয়া যায় প্রতিবন্ধীদের।
একটি ব্যাঙ্কের অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের অর্থানুকূল্যে যেমন খণ্ডঘোষের কূলজোড়া গ্রামের শেখ জালালুদ্দিনকে ট্রাইসাইকেল জোগাড় করে দিয়েছেন সুদীপ। জালালুদ্দিনের কথায় ঝরে পড়ে কৃতজ্ঞতা, “সুদীপদা ট্রাইসাইকেলটা জোগাড় করে না দিলে আমার বাড়ি থেকে বের হওয়াই হত না। কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকাটাও উনিই দিয়েছেন।” নিজের গ্যাঁট থেকে এ রকম প্রায় ১৬-১৭ জন প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীর স্কুল-কলেজের বেতন বা বইপত্রও জুগিয়ে চলেছেন সুদীপ।
গত কয়েক বছর যাবৎ তাঁদের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মুখপত্র হিসেবে একটি পত্রিকাও বের করা হয় । তাতে এক দিকে যেমন প্রতিবন্ধীদের নানা কর্মসংস্থান ও অধিকার সম্পর্কে তথ্য ছাপা হচ্ছে, থাকছে শারীরিক বাধা জয় করে স্বপ্ন আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার বৃত্তান্তও। বর্ধমান ছাড়াও আশপাশের বাঁকুড়া-পুরুলিয়া মিলিয়ে শ’দেড়েক প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণী তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতরের সহ-অধিকর্তা লিয়াকত আলি বলেন, “এক সময়ে আমি বর্ধমানে ছিলাম। তখনই সুদীপের আন্তরিক চেষ্টা চোখে পড়ে। কয়েক বছর আগেই আমরা ওকে ‘রোল মডেল’ বলে চিহ্নিত করে শংসাপত্র দিয়েছি।”
সুদীপবাবু বলেন, “আমি চাই, সকলেই কষ্ট করে লেখাপড়া শেষ করুন। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোন।” দিগন্ত দূর নয়। |