বছর পেরিয়ে
সরেছে বাহিনী, স্কুল আবার পড়ুয়ার দখলে
মোরামের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল ছোট-ছোট হাতগুলো।
“ওই তো, ওই রাস্তা দিয়েই চলে যান। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি পেয়ে যাবেন” বলে দিল ক্লাস ফোরের একটি মেয়ে।
মেয়েটা যে একতলা মলিন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, লালগড়ের সেই বড় জামদা প্রাথমিক স্কুলেই ক্লাসে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের সামনে শিক্ষক কার্তিক মাহাতোকে খুন করেছিল মাওবাদীরা।
সেটা ছিল ২০০৯ সাল। তখনও গোটা এলাকা জুড়ে মাওবাদী আর জনগণের কমিটির দাপট। মাঝে-মাঝে যৌথ বাহিনীর ভারী বুটের শব্দ। কিষেণজি তখনও বহাল তবিয়তে।
গত এক বছরে সেই স্কুল অনেক পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু ভয়ঙ্কর দিনটার স্মৃতি পিছু ছাড়েনি। ক্লাস ফোরের মেয়েটি তখন সবে প্রথম শ্রেণি। তার মনে পড়ে, “মাস্টারমশাই আমাদের পড়াচ্ছিল। হঠাৎ কয়েক জন ঢুকে পড়ে গুলি চালিয়ে দিল। আমরা ভয়ে চেঁচাতেছিলাম। বাইরে থেকে কপাট লাগিয়ে দিল ওরা।”
পাশ থেকে মেয়েটির এক বন্ধু বলে ওঠে, “রক্তে ভাসা দেহটা টানতে টানতে ওরা নিয়ে গিয়েছিল ওখানে।” কোথায়? অনেকগুলো আঙুল ওঠে। “ওখানে।” “না না, আর একটু এগিয়ে!” “একটু বাঁ পাশে, দরজার দিকে” এখন আর ঠিক করে বলতে পারে না ওরা। আড়াই বছর অনেকটা সময়। সময়টা পাল্টাচ্ছে।
শিক্ষাই যে মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলার অন্যতম হাতিয়ার, গত ১১ অগস্ট তা ফের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী শশী তারুর।
কিন্তু এখনও জঙ্গলমহলে ঘুরে মনে হয়, সন্ত্রাস রোখার হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষার গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল, তা এ রাজ্যে এখনও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো স্কুলের ক্যাম্পগুলি ছেড়ে চলে গিয়েছে যৌথবাহিনী, কিন্তু তাদের ভেঙে-চুরে দিয়ে যাওয়া বেঞ্চ-টেবিল বদলে আসেনি নতুন আসবাব।
শালবনির চাঁদড়া পঞ্চায়েতের ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরীর আক্ষেপ, “স্কুলের যাবতীয় টেবিল চেয়ার নষ্ট হয়েছে। ছাত্ররা কিছু বলতে সাহস পায়নি। ওদের মানসিক ক্ষতিও অপূরণীয়।”
কোথাও আবার মাওবাদীদের হাতে নিহত শিক্ষকের জায়গায় এখনও আসেননি নতুন শিক্ষক। সন্ত্রাসের ছায়া সরে যাওয়ার পরে শিক্ষার পরিকাঠামো যে ভাবে ঢেলে সাজার দরকার ছিল, তা সামান্যই হয়েছে।
২০০৯ সালে খুন হয়েছিলেন রামেশ্বরপুরের মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের বাংলার শিক্ষক রতন মাহাতো। তাঁর পদ এখনও পর্যন্ত ফাঁকাই পড়ে। ফাঁকা পড়ে আছে ইংরেজি শিক্ষকের পদও। গত দেড় বছরে পশ্চিম মেদিনীপুরে ১১৬টি স্কুলকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করা হলেও অধিকাংশ স্কুলেই পূর্ণ সময়ের শিক্ষক নেই। গ্রন্থাগারিক থেকে শিক্ষাকর্মী, কোনও পদেই পর্যাপ্ত কর্মী নেই। ঘাটতি রয়েছে শিক্ষকের সংখ্যাতেও।
এলাকার মানুষের কিন্তু শিক্ষার প্রতি আগ্রহ যথেষ্ট। স্কুলছুটের সংখ্যাও কমছে বলে মত অধিকাংশ শিক্ষকের। সে ক্ষেত্রে গ্রামবাসীদের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তাঁদের সাহায্যেই অনেক স্কুলে চলছে পাঁচিল দেওয়ার কাজ, জানান শিক্ষকেরা। রামেশ্বরপুর মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রেও আপাতত এলাকার দু’জন বিনা বেতনে বাংলা ও ইংরেজি পড়াচ্ছেন।
কিন্তু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে কোথায় যাবে পড়ুয়ারা? জঙ্গল পেরিয়ে আট কিলোমিটার দূরে পিড়াকাটা বা ভীমপুর মাধ্যমিক স্কুলে পৌঁছতে পারবে না হয়তো অনেকেই। যারা পারবে, তাদেরও মাধ্যমিক দেওয়া কঠিন হবে। কেননা শিক্ষার অধিকার আইনের চাপে কিছু নতুন উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু হলেও মাধ্যমিক স্কুলের সংখ্যা নেহাতই কম।
যেমন শালবনি ব্লকেই গড়ে ছ’টি প্রাথমিক পিছু রয়েছে বড় জোর একটি উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়। জেলা পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সঙ্ঘমিত্র মাকুরও মেনে নেন, “জঙ্গল এলাকায় সর্বত্র সমান ভাবে স্কুল করে ওঠা যায়নি এখনও।”
এর উপরে রয়েছে হস্টেলের অভাব। রামগড় মোক্ষদাসুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়ে বেশির ভাগ পড়ুয়াই আশপাশের লকাট, ধানশোলা, অরমা, খাসজঙ্গল থেকে আসে। কিন্তু ১০০ জন আবাসিকের জন্য রয়েছে মাত্র চারটি ঘর।
এক-একটি ঘরে ১৬-১৭ জনকে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। হস্টেল ভবনের জন্য বরাদ্দ টাকা প্রশাসনিক তৎপরতার অভাবে ফিরে গিয়েছে বলেও অভিযোগ।
সরকারি ‘ডাইস’ রিপোর্ট অনুযায়ী, জেলার ৫৭২৭টি প্রাথমিক স্কুলের মধ্যে ৩৯০৯টিরই পাঁচিল নেই। ৩৫৫১টি প্রাথমিক স্কুলে চালু হয়নি শৌচাগার।
লোধাশুলির লবকুশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুভাশিস মণ্ডল জানান, সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পের টাকায় স্কুলবাড়ি হলেও ছেলেদের শৌচাগার হয়নি।
এত সমস্যা সত্ত্বেও কিন্তু খুদেদের উৎসাহে ঘাটতি নেই। শুভাশিস বলছিলেন, “আমরা ফিনাইল আনতে ভুলে গেলে ওরাই মনে করিয়ে দেয়। পয়সা জমায় রংপেন্সিল কিনবে বলে।”
স্কুলের রেজিস্টার খাতা থেকে শিক্ষকদের ধারণা, জঙ্গলমহলের ৬৫ শতাংশ পড়ুয়াই আসছে দারিদ্রসীমার নীচের পরিবার থেকে।
বন্দুক সরে গেলেও খিদে, অপুষ্টি বা দীর্ঘ পথ হাঁটার পরিশ্রমের সঙ্গে কিন্তু শিশুদের লড়াই চলছেই।

পথ বাকি
শিক্ষার অধিকার আইন বলে
• প্রতি কিলোমিটারে চাই ১টি করে প্রাথমিক স্কুল,
প্রতি ৩ কিলোমিটারে ১টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল
উচ্চ প্রাথমিক স্কুল
ব্লক রয়েছে আরও চাই
মেদিনীপুর সদর ২৬ ১১
শালবনি ২৬ ২৯
বিনপুর ১ ৩৫ ১০
বিনপুর ২ ৩৯ ২৩
নয়াগ্রাম ৪০ ১২
গোপীবল্লভপুর ১ ২৫ ১৮
গোপীবল্লভপুর ২ ২৪ ২০
ঝাড়গ্রাম ৪১ ২৫

প্রাথমিক স্কুল
৫৭২৭
শৌচাগার রয়েছে
২১৭৬
(তথ্যসূত্র: প্রতীচী ট্রাস্ট)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.