শিল্পের কথা মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা গেল বারবার। কিন্তু শিল্প বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছে রাজ্য সরকার, তা নিয়ে আরও এক বার ধোঁয়াশা তৈরি করে দিলেন তিনি নিজেই। শনিবার হস্তশিল্প মেলা উদ্বোধনের মঞ্চ থেকে রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যতের কথা বলতে গিয়ে ক্ষুদ্রশিল্প আর কলাশিল্পকে একাসনে বসিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখে লগ্নি টানার কথা যতই বলুন, তার আগমন যে আশানুরূপ নয়, তেমন ইঙ্গিত কিন্তু এ দিন মমতার কথাতেই মিলেছে। হস্তশিল্প মেলায় মুখ্যমন্ত্রী সোজাসুজি বলে দিয়েছেন, “বড় শিল্প অনেকের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।” তা হলে উপায়? মমতার দাবি, ক্ষুদ্রশিল্পকে আঁকড়েই পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ব-বাজার ধরবে। তাঁর মতে, বন্দর-কারখানা-তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প-ইলেকট্রনিক্স পার্ক তৈরি হোক। কিন্তু সেটাই সব নয়। জোর দিতে হবে ক্ষুদ্রশিল্পের উপরে। বাম আমলে ক্ষুদ্রশিল্পের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করে তিনি জানান, সেই ছবিটা বদলে দিতেই ক্ষুদ্রশিল্প দফতরটি তিনি নিজের হাতে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই দফতরকে পৃথিবীর এক নম্বর সেরা কাজে ব্যবহার করতে চাই।”
কী ভাবে? সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই মমতা ক্ষুদ্রশিল্পের প্রচলিত সংজ্ঞা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করে কলাশিল্পের পরিসরে ঢুকে পড়েন। তিনি বলেন তাঁর দফতরের মধ্যে দিয়ে শিল্পীরা যাবে, সাংস্কৃতিক কর্মীরা যাবে, সঙ্গীতশিল্পীরা যাবে, নাটক বানাবে, যাত্রা করবে, সিনেমা দেখাবে...। এ কথা বলে তিনি নিজেই প্রশ্ন তোলেন, “কেন নয়? শুধু কাঠের শিল্প, সিমেন্টের শিল্প, লোহার শিল্পই কি শিল্প?” মমতার এই কথা থেকেই তৈরি হয়েছে নতুন ধোঁয়াশা। শিল্পমহলের অনেকেই মনে করছেন, শুধু ক্ষুদ্রশিল্পের মধ্যে কলাশিল্পকে ঢুকিয়ে দেওয়াই নয়, সামগ্রিক ভাবে ‘আর্ট’ এবং ‘ইন্ডাস্ট্রি’কে একাকার করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর তার ফলে সরকারের শিল্প-নীতি কতটা স্বচ্ছ, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। পাশাপাশি শিল্পের প্রশ্নে মমতা যে আসলে কতটা চাপে, সেটাও বেরিয়ে পড়ল বলে মনে করছেন তাঁরা। |
পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করার জন্য যতই আমন্ত্রণ জানানো হোক, সেটা শিল্পপতিদের কতটা আকৃষ্ট করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সিঙ্গুর আন্দোলনের নেত্রী ক্ষমতায় আসার পরে গত দেড় বছরে রাজ্যে বলার মতো নতুন কোনও বড় লগ্নি আসেনি। শালবনি, কাটোয়া, রাজারহাটের চলতি প্রকল্পগুলি নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা। হলদিয়া থেকে এবিজি বিতাড়নের পর শিল্পের পরিবেশ নিয়ে আতঙ্কের মাত্রা আরও বেড়েছে।
শিল্প-বিরোধী তকমা মোছার চেষ্টায় সামনের মাসে দিল্লিতে শিল্প সম্মেলনের আসর বসাচ্ছে রাজ্য সরকার। এ দিন রাজধানীর শিল্পমেলায় পশ্চিমবঙ্গ প্যাভিলিয়ন পরিদর্শনেও গিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। কিন্তু এ সবে কাজের কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সব মহলেই। ঠিক যে ভাবে রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যতই এক লক্ষ ন’হাজার কোটির লগ্নি এসেছে বলে দাবি করুন, প্রকৃত চিত্রটি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই। চলতি সপ্তাহে খোদ মুখ্যমন্ত্রীই মন্ত্রী-আমলাদের সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়ে যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বস্তুত, শিল্পমহলের ক্ষোভ এবং বিভিন্ন মহলে আলোচনা যে চাপ তৈরি করছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রী মুখে শিল্পের কথা বললেও তার রূপরেখা স্পষ্ট হচ্ছে না বলেই মনে করছেন অনেকে। শনিবার মমতার বক্তব্য শোনার পরে একই মত শিল্পমহলেরও। তাঁদের বক্তব্য, এই কথায় ধন্দ বেড়েছে। |
...ক্ষুদ্রশিল্প দফতরকে পৃথিবীর এক নম্বর সেরা কাজে আমরা ব্যবহার করব। এর মধ্যে দিয়ে শিল্পীরা যাবে, সাংস্কৃতিক কর্মীরা যাবে, সঙ্গীতশিল্পীরা যাবে, নাটক বানাবে, যাত্রা করবে, সিনেমা দেখাবে। কেন নয়? শুধু কি কাঠের শিল্প, সিমেন্টের শিল্প, লোহার শিল্পই শিল্প? |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে অনেকগুলো জটিলতার স্পষ্ট উত্তর চায় শিল্পমহল। এখনও পর্যন্ত শিল্পের জন্য জমি না নেওয়ার নীতিতে অনড় রয়েছেন মমতা। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন নিয়ে সরকারি অবস্থানেও খুশি নয় শিল্পমহল। জমি ব্যাঙ্কের কথা সরকার বারবার বললেও তার মধ্যে শিল্প-উপযোগী জমির পরিমাণ আদতে কতটুকু, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। রাজ্যে সার্বিক ভাবে শিল্পবন্ধু পরিবেশের অভাব রয়েছে বলেও শিল্পমহলের দাবি। এ দিনের বক্তৃতায় এ সব নিয়ে মমতা কোনও কথা বলেননি। প্রশ্ন উঠেছিল, শিল্পপতিদের চেয়ে চিত্রতারকাদের সান্নিধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী বেশি স্বচ্ছন্দ কি না? এ দিনও মমতার কথায় চলচ্চিত্র উৎসবের সাফল্যের কথা উঠে এসেছে। চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ থেকে মমতা বিনোদন শিল্পে রাজ্য সরকারের আগ্রহের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এ দিন তিনি শিল্পের সংজ্ঞা নিয়েই যে ভাবে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন, তাতে বিনোদনশিল্প এবং কলাশিল্পের মধ্যেকার ব্যবধানও ঘুচে গেল কি না, সেই জল্পনাও শুরু হয়েছে। মমতা এ দিন বলে দিয়েছেন, “যে শিল্পে শিল্পী নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, সেটাই শিল্প।” মমতার ক্ষুদ্র শিল্প দফতর আপাতত এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। বয়স্ক হস্তশিল্পীদের মাসিক ৭৫০ টাকা ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য। শান্তিনিকেতনে তৈরি হবে ‘বিশ্ব ক্ষুদ্র বিগ বাজার’। এ জন্য জমিও চিহ্নিত করা হয়ে গিয়েছে বলে জানান মমতা। |