তৃণমূলের জমানার দেড় বছরের মাথায় জমির ভূত ঝেড়ে আবার উঠে দাঁড়াতে চাইছে সিপিএম! শিল্প ছাড়া রাজ্যের অগ্রগতি সম্ভব নয়, এই বার্তা নিয়ে জনমত গড়ে তুলতে চাইছে তারা। বিরোধী দল হিসাবেই।
শিল্পায়নের কর্মসূচি নিয়ে এগোতে গিয়েই জমি আন্দোলনের ধাক্কায় ক্ষমতা হারাতে হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। সামনে পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোট। এখন সিপিএমের মুখে ফের শিল্পের কথা মানে কি ফের তারা সুযোগ পেলে জমি নিয়ে নেবে, গ্রামবাসীদের মধ্যে এই প্রচার শুরু হয়ে যেতে পারে? এমন আশঙ্কাকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না আলিমুদ্দিন।
তাদের বরং মনে হচ্ছে, শিল্পের বেহাল দশায় গত কয়েক বছরে রাজ্যে যে দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, রাজ্যবাসী তা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। শিল্প ছাড়া যে এগোনোর পথ নেই, এই বাস্তব মানুষকে বোঝানোর তৎপরতাও তাই শুরু করে দিয়েছে সিপিএম।
দলের প্রচারের কর্মসূচির সামনের সারিতে শিল্পকে স্থান দেওয়ার উদ্যোগে বুদ্ধবাবু, নিরুপম সেন, সূর্যকান্ত মিশ্রের মতো রাজ্য সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব একমত। বুদ্ধবাবু নিজেই এই বিষয়ে বিশেষ ভাবে উদ্যোগী। তিনি বোঝাচ্ছেন, জিন্দল, ইনফোসিস, উইপ্রো বাম জমানায় ব্যবস্থা করে যাওয়া একের পর শিল্প পরিকল্পনা স্তব্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। দেড় বছরে নতুন শিল্প আনার ক্ষেত্রে এক পা-ও এগোতে পারেনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। দলীয় মঞ্চে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “বিদ্যুতের কী হবে? কল-কারখানা আসেনি বলে এখনও বিদ্যুৎ চলছে। কাটোয়ায় সব ব্যবস্থা করে এলাম। একটু জমি বাকি ছিল। এই সরকার বলছে, না! জমি হবে না! পাঁচ বছরে কারখানা না-হলে রাজ্য ফের অন্ধকারে ডুববে!” শিল্পায়নের পদ্ধতিতে যে তাঁদের জমানায় কিছু ভুল হয়েছিল, তা মেনে নিয়েই বুদ্ধবাবু বলছেন, “আমরা ভুল করেছি বলে মানুষ আমাদের সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কাদের আনলেন? এরা কারা?”
শিল্প নিয়ে আসার দায়িত্ব সরকারের। বিরোধীদের নয়। কিন্তু রাজ্যের স্বার্থে তাঁরা যে শিল্প চান, এই মর্মে ধারাবাহিক ভাবে বিবৃতি দেওয়া এবং সুযোগ মতো রাজ্য সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুকে। দলের শ্রমিক সংগঠন সিটুর সদ্যসমাপ্ত রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে একটি পুস্তিকায় প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপমবাবু লিখেছেন, শিল্পের দাবিতে সওয়াল করার দায়িত্ব শ্রমিকদেরও নিতে হবে। কারণ, কারখানা না-থাকলে শ্রমিকদের মজুরিও বাড়বে না, সমস্যাও মিটবে না। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপমবাবুর কথায়, “শিল্পের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে চাই। শিল্প ছাড়া এগোনোর পথ নেই। সিঙ্গুরে কারখানা হলে কার ক্ষতি হত? পশ্চিমবঙ্গের এমনিতেই বহু ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের জন্য, অর্থনীতির জন্য যা জরুরি, সেই কথা বলতেই হবে।”
নিরুপমবাবুর মত, সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতিতে মন্দা চলছে বলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার থমকে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার আবেদন করলেই হুড়হুড় করে শিল্প এসে পড়বে না। এই সময়ে সরকারের উচিত সড়ক, বন্দর, বিদ্যুতের মতো পরিকাঠামো নির্মাণে জোর দেওয়া। কিন্তু জমির জটে এ রাজ্যে সে সব কাজই আটকে!
আবার শিল্পের হয়ে জোর সওয়াল করতে গিয়ে রাজনৈতিক ভাবে বিরুদ্ধ প্রচারের সামনে কি পড়তে হতে পারে না? প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্য, “সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরে মানুষের মনে অনেক ভুল ধারণা তৈরি করে দেওয়া হল! সেগুলো ভাঙতেই হবে। যা অবস্থা তৈরি হয়েছে, কাল যদি বামফ্রন্ট বা অন্য কেউ ক্ষমতায় আসে, তারাও তো কিছু করতে পারবে না! কোথাও জমি পাওয়া যাবে না! এই অবস্থা থেকে রাজ্যকে বার করে আনতেই হবে।” শুধু বিজয়া সম্মিলনীর আসরে মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের মুখোমুখি হলেই যে শিল্পের পরিবেশ তৈরি হয় না, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েই নিরুপমবাবুর সংযোজন, “আমি তো যত দিন থাকব, বলেই যাব শিল্পের দিকে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে রাজ্যটার যে ক্ষতি তৃণমূল করেছে, আর কোনও দল কখনও করেনি!”
বুদ্ধ-নিরুপম-সূর্যবাবুদের পক্ষে স্বস্তির খবর, দলের অন্দরে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার মতো নেতারাও তৃণমূলের শিল্প ও জমি-নীতির বিরুদ্ধে সরব। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সময় ভূমিমন্ত্রী রেজ্জাকের সঙ্গে প্রবল বিরোধ ছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর। কিন্তু এখন রেজ্জাক বলছেন, “শিল্পের কথা বলা মানে জমি কেড়ে নেওয়ার প্রচার ফিরে আসা নয়। তৃণমূল বন্ধ্যা নীতি নিয়ে চলছে! সরকারি প্রকল্পের জন্যও জমি পাওয়া যাচ্ছে না। ওদের বলা যায়, দে হ্যাভ বিন পেইড ব্যাক ইন দেয়ার ওন কয়েন!”
রেজ্জাকের মতে, বেসরকারি প্রকল্পের জন্য জমি নেওয়ার পদ্ধতি ঠিক কী হবে, তা নিয়ে জাতীয় স্তরেই দিশাহীনতা আছে। কিন্তু কোথাও কোনও কাজের জন্যই জমির প্রশ্নে সরকার হস্তক্ষেপ করবে না, এই অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। নতুন করে তাই কোমর বাঁধছেন বুদ্ধ-নিরুপমরা! |