রেলমন্ত্রী থাকাকালীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু বার বলেছিলেন, রেল-প্রকল্পের জন্য জমি নিলে পরিবারপিছু এক জনকে চাকরি দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি বলেছেন, আয়লা-বিধ্বস্ত সুন্দরবনে বাঁধ নির্মাণের জন্য নেওয়া জমির মালিকদের পরিবারপিছু এক জনের কর্মসংস্থান হবে। সরকারের খসড়া জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিলেও বলা ছিল, কোনও প্রকল্পের জন্য জমি নিলে প্রয়োজনে পরিবারপিছু এক জনকে চাকরি, অথবা এককালীন মোটা টাকা দেওয়া হবে।
বাস্তবে কী হয়েছে? প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিকে কটাক্ষ করে বর্তমান রেল-প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী বলেছেন, “কথা রাখা সম্ভব নয়।” বাঁধ-প্রকল্পে জমি নিলেও লিখিত ভাবে কখনওই চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী শ্যামল মণ্ডল। তথ্য বলছে, গত দেড় বছরে রাজ্যে সরকারি প্রকল্পে নেওয়া জমির বদলে চাকরি দূরস্থান, বাড়তি অর্থও জোটেনি জমি-মালিকদের!
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা ও বাস্তবে এ হেন ফারাক দেখে প্রশাসন ও শিল্পমহলের একাংশ বিস্মিত। তাদের প্রশ্ন, বেসরকারি প্রকল্পের জন্য জমি নেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার তরফে জমি-মালিকদের যে সব সুবিধা দেওয়া উচিত বলে সরকার মনে করে, নিজেরা সেগুলো কার্যকর করছে না কেন?
আয়লার বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রশ্নটা বেশি প্রকট। শ্যামলবাবু জানান, এ পর্যন্ত ৬৮৫ একর জমি হাতে এসেছে, যার অর্ধেকের বেশি মিলেছে এই সরকারের আমলে। প্রথম পর্যায়ে নির্ধারিত ২৬৩ কিমির মধ্যে ২০ কিমির মতো বাঁধ চলতি অর্থবর্ষে তৈরি হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।
জমিহারারা কী পাচ্ছেন? শ্যামলবাবু জানান, আইন মেনে ওঁদের দেওয়া হচ্ছে জমির দাম এবং ৩০% সোলেসিয়াম। অ-নথিভুক্ত বর্গাদার ও সরকারি জমির দখলদার পরিবারকেও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে গত ২৯ সেপ্টেম্বর নতুন বিজ্ঞপ্তিতে সরকার জানিয়েছে। কিন্তু চাকরির যে প্রতিশ্রুতি মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তার কী হল?
শ্যামলবাবুর জবাব, “ওটা চূড়ান্ত হয়নি। কাগজে-কলমে কোনও সিদ্ধান্তও হয়নি। এর পর ভবিতব্যের ব্যাপার।” মন্ত্রীর মন্তব্য, “জমির দাম মেটাতেই পাগল হয়ে যাচ্ছি!”
রেলের জমির বিনিময়ে চাকরির আশাও বিশ বাঁও জলে। মমতার পদাঙ্ক মেনে মুকুল রায়ও একই প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ইউপিএ ছেড়ে তৃণমূল বেরিয়ে আসার পরে নতুন রেল-প্রতিমন্ত্রী অধীরবাবু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রেলের জন্য জমি নিলে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়।
শুধু রেল প্রকল্প বা আয়লার বাঁধই নয়। ভোটের আগে ও রাজ্যে ক্ষমতায় এসে মমতা জমি সংক্রান্ত যে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার প্রায় সবই এখনও অধরা। যেমন, তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারের ১৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছিল, ‘১৮৯৪ সালের দানবীয় জমি অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী মা-মাটি-মানুষের সরকার কোথাও এক কাঠা জমি নেবে না।’ আবার অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিলের যে খসড়া গত ডিসেম্বরে তড়িঘড়ি প্রকাশ্যে এনেও পরে তুলে নেওয়া হয়, তার বক্তব্য: বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগের জন্য রাজ্য জমি অধিগ্রহণ করবে না। সরকারি প্রকল্পে জমি নিলে প্রয়োজনে জমিহারা পরিবারের অন্তত এক জনকে গ্রুপ-ডি বা সমতুল পদে কাজ দেওয়া হবে। অন্যথায় দেওয়া হবে এককালীন দুই থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা। এর বাইরেও আর্থিক সাহায্যর প্রতিশ্রুতির পাশে এক বছর ধরে মাসে ৩ হাজার টাকা ভাতার কথাও রয়েছে খসড়ায়। এ-ও বলা হয়েছে, গ্রামে জমির নির্ধারিত দামের দ্বিগুণ দেবে রাজ্য। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকার প্রতিশ্রুতির ধারে-কাছেও পৌঁছায়নি!
যেমন, বর্তমান অধিগ্রহণ আইনেই সরকারি প্রকল্পের জন্য দেদার জমি নেওয়া হচ্ছে। আয়লা-আর্সেনিক-পানীয় জল-রাস্তা-সেতুর মতো বিভিন্ন কাজে গত দেড় বছরে কয়েক হাজার একর অধিগ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রক্রিয়া শেষ করতে রাজ্য মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে। কেন্দ্রীয় আইন মেনে দেওয়া হচ্ছে জমির দাম, সঙ্গে ৩০% সোলেসিয়াম। নয়া সরকারের দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও জমিহারারা বাড়তি আর্থিক সাহায্য পাচ্ছেন না কেন? মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠমহলের ব্যাখ্যা: কেন্দ্র নতুন জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নীতি তৈরি করছে। তা কার্যকর হলে রাজ্য নিজস্ব নীতি প্রণয়ন করে প্রতিশ্রুতি রাখবে। আপাতত কিছু করার নেই।
প্রশাসন ও শিল্পমহলের একাংশ এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের দাবি, যে আইনেই জমি নেওয়া হোক, জমিহারাদের বাড়তি সুযোগ দেওয়াটা ইচ্ছার উপরে নির্ভর করে। ঠিক যে ভাবে মমতা রেল বা বাঁধের জন্য জমিদাতাদের পরিবারপিছু চাকরির কথা বলেছেন, আইনি বাধ্যবাধকতা না-থাকা সত্ত্বেও। শিল্পমহলের এক মুখপাত্র বলেন, সিঙ্গুর-সহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রকল্পের জন্য জমি ১৮৯৪-এর আইন মেনে অধিগ্রহণ করা হলেও বেসরকারি সংস্থার তরফে জমিহারাদের অতিরিক্ত সুযোগ দেওয়া আটকায়নি।
শিল্প-মুখপাত্রটির বক্তব্য: আইন মোতাবেক জমির দাম, সোলেসিয়াম তো আছেই। তার বাইরে কিছু ক্ষেত্রে জমির বদলে জমি, এককালীন অর্থ, প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ, প্রকল্পে অংশীদারিত্ব দেওয়ার ঘোষণাও হয়েছে। “প্রকল্পের জন্য জমি নিলে এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নের দায়ভার নেওয়া এখন বাধ্যতামূলক। বেসরকারি সংস্থারা যখন এই কর্পোরেট সোস্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) পালন করছে, তখন সরকারি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকার বাড়তি কিছু দেবে না কেন?” প্রশ্ন তাঁর। প্রশাসনিক-সূত্রের খবর: তেমন সাধ্য এই মুহূর্তে রাজ্যের নেই। যে কারণে খসড়া জমি বিলেও সংশোধন এনে সরাসরি চাকরির প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার ভাবনা শুরু হয়েছে। |