|
|
|
|
সচেতনতার অভাব, শিশুশ্রমিক স্কুলেও কাটছে না সঙ্কট |
জিৎদের কাছে আগে পেট, পরে পড়া |
নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর ও তমলুক |
আজ ১৪ নভেম্বর। শিশুদিবস। জেলা জুড়েই নানা কর্মসূচিতে পালন করা হবে দিনটি। কিন্তু ওদের খোঁজ কে রাখে?
জিৎ রাণা, বাবুসোনা রাণা, শাহ আলমদের শৈশব হারিয়ে গিয়েছে। ওদের কেউ সাইকেল মেরামতের কাজ করে। কেউ দোকানে, কেউ আবার রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে। এই সব শিশু শ্রমিকদের কাছে শিশু দিবসের আলাদা কোনও মাহাত্ম্য নেই। আজকেও সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরনো, তারপর দিনভর কাজ। আইন থাকলেও শিশুশ্রম বন্ধ করা যায়নি। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্তও মানছেন, “এ জন্য সর্বস্তরে আরও সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।”
জিৎ রাণার বাড়ি মেদিনীপুরের রাঙামাটিতে। এক চিলতে ঘরের সর্বত্র দগদগে অনটন। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিল জিৎ। তবে দ্বিতীয় শ্রেণির পরে আর এগোতে পারেনি। বাবা কৃষ্ণ রাণা রিকশা চালান। মা শোভাদেবী পরিচারিকা। দিদি প্রিয়াঙ্কাও মায়ের সঙ্গে কাজে যায়। কয়েক মাস হল কেরানিতলার এক সাইকেল সারানোর দোকান কাজ করছে বছর দশেকের জিৎ। আগে অন্য দোকানে কাজ করত। জিতের কথায়, “কাজ না করলে খাব কী? এখানে কাজ করে দিনে ৩০ টাকা পাই। সেটা সংসারে দিই।” শিশুদিবস শব্দটায় ভাবান্তর না হলেও কালীপুজো নিয়ে তুমুল উৎসাহ এই কিশোরের। বলছিল, “আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি যাব। কালীপুজো তো। মা বলেছে, বাজি কিনে দেবে।”
প্রায় একই অবস্থা বাবুসোনার। বছর এগারোর এই কিশোরের বাড়ি মেদিনীপুরের কালগাঙে। পড়াশোনা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। বাবা তরুণ রাণা রিকশা চালক। মা রেখাদেবী পরিচারিকার কাজ করেন। এক বোন, এক দিদিও রয়েছে। জগন্নাথমন্দির চকের একটি দোকানে কাজ করে বাবুসোনা। তার কথায়, “আজ না হোক কাল, কাজ তো করতেই হবে। এখন দিনে ৭০ টাকা পাই। তার মধ্যে বাড়িতে ৬০ টাকা দিই। টিফিন খরচের জন্য নিজের কাছে ১০ টাকা রাখি।” বছর চোদ্দোর শাহ আলম আবার বাড়ি তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত। মার্বেলের লাগানোর কাজ করে সে। |
|
|
|
জিৎ রাণা |
বাবুসোনা রাণা |
শাহ আলম |
|
বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায়। এখন মেদিনীপুরের পালবাড়িতে কাজ করছে। বাবা শেখ শাহজাহান আলি রাজমিস্ত্রি। মা সাবেরা বিবি স্কুলে রান্না করেন। বাড়িতে আর আছে এক বোন ও এক দিদি। নবম শ্রেণির পরে পড়ায় দাঁড়ি পড়েছে। শাহ আলমের সাফ কথা, “কাজ না করলে কী চলবে? কাজের জন্যই পড়াশোনা ছেড়েছি।”
১৯৯৬ সাল থেকে শিশুশ্রম বন্ধে আইন চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই সময় দেখা গিয়েছিল, দেশে প্রায় দেড় কোটি শিশু শ্রমিক রয়েছে। এ রাজ্যে প্রায় ২ লক্ষ। কিন্তু আইন করেও বন্ধ করা যায়নি শিশুশ্রম। তবে শিশু শ্রমিকদের শিক্ষার আঙিনায় এনে জীবন পাল্টানোর চেষ্টা চলছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে সেই লক্ষ্যে কাজ করছে ৪২টি শিশু শ্রমিক স্কুল রয়েছে। এই স্কুলগুলিতে বছরে গড়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১ হাজার ৮০০ জন। এখনও পর্যন্ত এই জেলায় শিশুশ্রমিক স্কুল থেকে ১৪১ জন মাধ্যমিক পাশ করেছে। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে ৩৪ জন। এই স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের মাসে দেড়শো টাকা ভাতা ও একবেলা খাবার দেওয়া হয়। মাঝেমধ্যে দেওয়া হয় নতুন পোশাক। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলেই সব শিশু শ্রমিককে স্কুলমুখী করা যায়নি।
পূর্ব মেদিনীপুরেও প্রচুর শিশু শ্রমিক। এরা মূলত ইটভাটা, খাবার ও চা দোকান বা গৃহস্থের বাড়িতে কাজ করে। উপকূলবর্তী এই জেলায় সমুদ্রে মাছধরা ও বাছাইয়ের কাজেও যুক্ত রয়েছে অনেকে। অতিরিক্ত জেলাশাসক সুমন হাওলাদার জানান, জেলায় মোট ৩১টি শিশু শ্রমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ২৮টি স্কুল চালু রয়েছে। প্রতিটি স্কুলে গড়ে ৪০-৫০ জন পড়ুয়া অর্থাৎ জেলায় প্রায় ১৩০০ শিশুশ্রমিকের পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, প্রতিটি বিদ্যালয়ে চার জন করে শিক্ষক, কর্মী রয়েছে। তবে ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে এই সব শিক্ষকেরা পারিশ্রমিক ও বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা মাসিক ভাতা পাচ্ছিলেন না। তাতে সঙ্কট তৈরি হয়। কয়েক দিন আগে ওই বকেয়া অর্থ দেওয়া হয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের শিশু ও নারী উন্নয়ন দফতরের কর্মাধক্ষ্য অপর্ণা ভট্টাচার্য বলেন, “কয়েক বছর আগে পর্যন্ত জেলায় ২৩টি শিশুশ্রমিক স্কুল ছিল। আমরা উদ্যোগী হয়ে আরও ১২টি স্কুলের অনুমোদন আদায় করেছি। এর মধ্যে ৮টি স্কুল চালু হয়েছে। সব স্কুলেই মিড-ডে মিল চালু হয়েছে।” |
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ। |
|
|
|
|
|