প্রবন্ধ ২...
কোথায় আমার স্বভূমি
পার বাংলায় বাড়িঘরদোর ফেলে কলকাতায় এসে নবজীবন কলোনিতে একটু থিতু হওয়ার পর ঈশ্বর তার ছোট্ট বোন সীতাকে বলেছিল, ‘আমাদের নতুন বাড়িটা খুঁজছিলাম রে।’ সীতা বলে ‘পাওয়া গেছে?’ ঈশ্বর জানিয়েছিল, ‘হ্যাঁ, চল।’— ঋত্বিকের ‘সুবর্ণরেখা’। পঞ্চাশ বছর কেটে গেল, ’৬২-তে তৈরি, যদিও মুক্তি পেতে লেগেছিল আরও তিন বছর।
ঈশ্বর ভেবেছিল ফিরিয়ে আনতে পারবে নতুন বাড়ি, ফুরিয়ে যেতে দেবে না স্বপ্নকে। সেই ঈশ্বরই শেষ বয়সে ব্যর্থতা ভুলতে ঘুরে বেড়ায় কলকাতার আনাচকানাচে, বন্ধু হরপ্রসাদের সঙ্গে। রেস্তরাঁয় মদ্যপানে প্রায় চেতনা হারায় হরপ্রসাদ, বেয়ারা এসে ঈশ্বরকে পরামর্শ দেয়: বাবুকে বাড়ি নিয়ে যান। ক্লাউনের টুপি-পরা ঈশ্বর ঘাড় বাঁকিয়ে ঠোঁট কুঁচকে অস্ফুটে ককিয়ে ওঠে: ‘বাড়ি?’ নিরাশ্রয় উন্মূল মানুষ দু’টির জন্যে অতল অন্ধকারই তখন ‘বাড়ি’র প্রতিশব্দ।

বাড়ি তো সম্পর্কেরও আশ্রয়। ‘‘আমরা সকলেই জীবনের মূল হারিয়ে বাস্তুহারা হয়ে আছি... ‘বাস্তুহারা’ কথাটিকে এই ভাবে বিশেষ ভৌগোলিক স্তর থেকে সামান্য স্তরে উন্নীত করাই আমার অন্বিষ্ট।’’ বলেছিলেন ঋত্বিক, ‘সুবর্ণরেখা’ প্রসঙ্গে। প্রায় একই রকম কথা বলেছেন কিম কি-দুক, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, দুই কোরিয়ার স্বজন-হারানো পরিবার-হারানো মানুষজন নিয়ে। কিম দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রকার, তাঁর রচিত ও প্রযোজিত ছবি ‘পুংসান’ এ বারের কলকাতা ফিল্মোৎসবে দেখানো হচ্ছে। পুংসান, এক তরুণ, কী ভাবে দুই কোরিয়ার সীমান্ত এপার-ওপার করছে, তার সেই যন্ত্রণাময় ‘জার্নি’ নিয়েই ছবি। কিন্তু কিম কোনও রাজনৈতিক আখ্যান তৈরি করতে চাননি, একেবারেই ব্যক্তিগত স্তরে এই ছেদ বা বিচ্ছেদকে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
ব্যবধান। ‘পুংসান’ ছবির একটি দৃশ্য।
ষাট বছর পেরিয়ে গেছে, উত্তর আর দক্ষিণ কোরিয়ার ভাগাভাগি যে-সব মানুষকে পরিবার থেকে, স্বজন থেকে, স্বভূমি থেকে ছিন্ন করেছে, তাদের মধ্যে মাত্র দু’শো জন হয়তো মাসে এক বার পরস্পর দেখা করতে পারে— ছবিটি নিয়ে বলতে-বলতে জানিয়েছেন কিম। দু’দেশের মানুষই চায় একটাই ‘দেশ’ হয়ে উঠতে, কিন্তু রাজনীতি দুর্মর। কিম অবশ্য মনে করেন, দু’দেশের অধিবাসীই যদি পরস্পরকে বোঝার চেষ্টা করে, সম্মান করে, তবে একদিন-না একদিন একত্রিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হতেও পারে।
পুংসান-এর সঙ্গে ইরাক কিউবা সেনেগাল জার্মানির কিছু ছবি উৎসবে রাখা হয়েছে একই ব্যানারে: ‘হোয়্যার ইজ মাই ল্যান্ড’?

এ প্রশ্ন মহমত্-সালেহ্ হারুন-এরও। নিজের দেশে পরবাসী তিনি। আফ্রিকার শাদ-এ জন্মেছেন ১৯৬০-এ, আজও তাঁকে সইতে হচ্ছে নিরন্তর গৃহযুদ্ধের চাপ। ‘আ স্কিমিং ম্যান’, তাঁর যে ছবিটা দেখানো হচ্ছে এ বারের উৎসবে, তা নিয়ে বলতে-বলতে তিনি পৌঁছে গিয়েছেন নিজের ফেলে-আসা জীবনের অভিজ্ঞতায়। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে দেখে আসছেন গৃহযুদ্ধ। পরিবারগুলি বিধ্বস্ত, পরিবারের মানুষগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছে তাদের সুকুমার বৃত্তি, নষ্ট হতে বসেছে পারস্পরিক সম্পর্ক।
এমনই এক পরিবারের দুই সাঁতার-পাগল বাবা-ছেলের গল্প বুনে চলেন হারুন তাঁর ছবিটিতে। নিজের জীবনের ছায়া কোথাও যেন চারিয়ে যায় ছবির ভিতরে। রাজনৈতিক অস্থিরতা শাদ-এর অধিবাসীদের ছিন্নমূল করে দেয়, স্বভূমিতে বাস করেও মানসিক ভাবে যেন তারা উদ্বাস্তু। তাঁর ছবির চরিত্রেরাও অনেকটা খাঁচাবন্দি সিংহের মতো, বলেন হারুন। আর বলেন, ‘অ্যাট সাম পয়েন্ট লায়নস হু আর কেপ্ট লক্ড আপ ফর আ লং টাইম লুজ দেয়ার মাইন্ডস।’
হারুনের আরও খেদ— এই আত্মবিস্মৃতি তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভিতটা যেন নড়িয়ে দিয়েছে। পুঁজি-শাসিত সংস্কৃতি অবিরত নিশ্বাস ফেলছে তাঁদের ঘাড়ের ওপর, খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছে, শিকড়ের সঙ্গে অনবরত ছেদ ঘটিয়ে চলেছে। তবু তাঁদের যে দৈনন্দিন নিভৃত ব্যক্তিজীবন, তার মধ্যেই লুকোনো আছে এক প্রতিস্পর্ধী যাপনীয়তা— যা ভিস্যুয়াল ইমেজ-এর ভিতর দিয়ে বাঙ্ময় করে রাখতে চান হারুন।
‘সুবর্ণরেখা’ নিয়েও সম্ভবত এমনটাই ভাবতেন ঋত্বিক। বলেছেন, ‘অনেক কিছুই এসেছে যা স্বতঃস্ফূর্ত এবং মনের একেবারে গভীর থেকে উৎসারিত। সেখানে আর যাই থাক, নিরাশা নেই। সমস্তক্ষণ সীতার মুখ এবং বিনুর মুখের ব্যবহার, এবং কিছু কিছু ল্যান্ডস্কেপের ব্যবহার, সে দিকেরই ইঙ্গিত দেয় বলে আশা করি।’

কাদের জন্যে ছবি করেন— এমন প্রশ্নে ঋত্বিক লিখছেন: ‘প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আমার জবাব ছিল একটাই, আমি নিজের জন্যেই করেছি...।’ ব্যক্তির নিরিখেই তিনি সমাজ-ইতিহাসকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেন। তাঁর ছবি করার ভঙ্গিটি ছিল ‘পার্সোনাল’। একই কথা বলেন ইরানের আসগার ফারহাদিও। এ বারের উৎসবে উদ্বোধনী ছবি তাঁর ‘আ সেপারেশন’, তাতে বাবা-মেয়ের যা সম্পর্ক তা নিয়ে তাঁর মন্তব্য: ‘আই ডিড ড্র অন মাই ওন এক্সপেরিয়েন্স, দ্যাটস সামথিং ভেরি পার্সোনাল।’
তাঁর ছবির মূল ভরটি একটি দশ বছরের মেয়ের একা হয়ে যাওয়ার ওপর, ছিন্নমূল হয়ে পড়ার সম্ভাবনার ওপর। তেহরানের মেয়েটির নাম তেরমেহ্। তার বাবা-মা যখন নিজেদের মধ্যে বিচ্ছেদ চায়, মেয়েটি ঠিক করতে পারে না সে কোন দিকে যাবে, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারে তাদের এতদিনকার বাড়িটা আর থাকবে না, দুটো ছাদে আলাদা হয়ে যাবে। এ-ও এক ধরনের উন্মূল উদ্বাস্তু হয়ে পড়া-ই তো!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.