|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
অলক্ষ্মীর উপাসনা, না কি অপমানের সমতা? |
একটি সমাজে বাণিজ্যে যতই বাড়বাড়ন্ত হোক, অল্প কিছু লোক যতই ‘করোড়পতি’ হয়ে উঠুক,
তাদের বস্তি পরিবেষ্টিত, ছ’শো ভৃত্যপরিচারিত ব্যক্তিগত প্রাসাদ যতই লক্ষ্মীমন্ত দেখাক
উৎকট বৈষম্যের ফলে সেই সমাজ অলক্ষ্মীরই উপাসক বুঝতে হবে। অরিন্দম চক্রবর্তী |
মুম্বইয়ে শিল্পপতি মুকেশ অম্বানী যে বাড়িটি বানিয়েছেন, তার ২৭টি তলায় চার লক্ষ বর্গ ফুট জায়গা রয়েছে। রয়েছে ১৬৮টি গাড়ি রাখার জায়গা, আর তিন তলা জোড়া ‘শূন্যের উদ্যান।’ এ দিকে কাজের তাগিদে শহরে আসা মানুষ মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না, হু হু করে বাড়ছে বস্তিবাসীর সংখ্যা। ভারত সরকারই সম্প্রতি জানিয়েছে, ভারতের বস্তিবাসী ব্রিটেনের জনসংখ্যা ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রতি বছর বস্তিতে ঠাঁই নিচ্ছে আরও ২০ লক্ষ মানুষ।
এ জাতীয় খবর পড়ে পড়ে বর্তমান নিবন্ধ লেখকের মনে একটা ‘উৎক্রোশ’ জন্মেছে। তাই লক্ষ্মীর আরাধনার পুণ্যলগ্নে সাম্য-বৈষম্য নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে যা ভাবছি, পড়ছি, বুঝছি, তা সংক্ষেপে লিখে ফেলছি। লক্ষ্মীর সঙ্গে যেমন ধনসমৃদ্ধির সম্বন্ধ, তেমনি সৌন্দর্যেরও সম্বন্ধ। সৌন্দর্যের অন্য নাম সুষমা। যার বিপরীত হল বৈষম্য। একটি সমাজে বাণিজ্যে যতই বাড়বাড়ন্ত হোক, অল্প কিছু লোক যতই ‘করোড়পতি’ হয়ে উঠুক, তাদের বস্তি পরিবেষ্টিত, ছ’শো ভৃত্যপরিচারিত ব্যক্তিগত প্রাসাদ যতই লক্ষ্মীমন্ত দেখাক উৎকট বৈষম্যের ফলে সেই সমাজ অলক্ষ্মীরই উপাসক বুঝতে হবে।
অপর মানুষ বা প্রাণীকে উৎপীড়িত, যন্ত্রণার্ত, দুঃখী দেখলে যে-কোনও সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের মনে যে সমবেদনা জাগে মহাভারত তাকেই বলেছেন ‘অনুক্রোশ’। যে নৈতিক ধর্মবোধ শুধু দণ্ডের ভয়ে অথবা পুরস্কার বা যশের আশায় নয়, ঔচিত্যমাত্র-নির্ভর শুভাশুভবুদ্ধি রূপে পরিণত হয়ে মানুষকে ‘মানবতা’ দেয়, তার মূলে থাকে, মহাভারতের মতে, অনুক্রোশ। প্রতিকারহীন অ-দণ্ডিত অন্যায় অবিচার দেখলে আমাদের ভিতরে যে ‘outrage’ হয়, তার মধ্যে কিন্তু অনুক্রোশের সঙ্গে এক তীব্র নিঃস্বার্থ আক্রোশের ব্যঞ্জনা আছে। তাই নতুন শব্দ বানিয়ে বললাম ‘উৎক্রোশ’, হয়তো ‘অনুক্রোধ’ও বলা যেত। |
|
সহনাগরিক। শহরের নাম কলকাতা, তবে সেটা নামমাত্র। |
তরুণ বঙ্কিমচন্দ্র ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে পঞ্চদশ লুই-এর রাজত্বের উৎকট বৈষম্য বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রজামধ্যে অন্নাভাব, হাহাকার রব তবে এ সভাপর্বের রাজসূয়, এ নন্দনকাননে ঐন্দ্র বিলাস এ সকল অর্থসাধ্য ব্যাপার সম্পন্ন হয় কোথা হইতে? সেই অন্নাভাবপীড়িত প্রজার জীবনোপায় অপহরণ করিয়া।... আর বড় মানুষেরা? তাহারা এক কপর্দক রাজকোষে অর্পণ করে না’
বর্তমান ভারতের সরকার বা ধনী-বণিক সম্প্রদায় মোটেই এই অর্থে প্রজানিপীড়ক নয়। আজও ভারতের সরকার কাগজকলমে জনকল্যাণকারী, দরিদ্রতমের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখা সরকার। বরং যে মার্কিন বাজারি অর্থনীতির আদর্শে ভারতের উচ্চবিত্ত সমাজ সব রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে ভারতের গরিবি হঠানোর ব্যবসায়ে নেমেছেন তাঁদের তুলনায় আজও ভারতের গণতন্ত্র সজীবতর। এই এবারকার (২০১২) পুজোসংখ্যা ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকাতেই স্বাতী ভট্টাচার্য গ্রামবাংলার পঞ্চায়েতি গণতন্ত্রের দুরবস্থার বর্ণনা করতে গিয়েও সাবলীল আশাবাদিতার সঙ্গে বলেছেন, ‘‘‘কিন্তু পাবলিক হল সেই জিনিস, ‘যাকে দাবায়ে রাখতে পারবা না’।” আধুনিক গণতন্ত্রের ‘জন্মভূমি’ আমেরিকার পাবলিক কিন্তু মোটেই এ রকম দুর্দম নয়। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করার নাম করে, বাণিজ্য উদ্যোগ ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে, পরদেশের সস্তা শ্রমোৎপন্ন পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের দ্বারা বিশ্বব্যাপী মহামুনাফার উদ্বৃত্তমূল্য ভোগ করার লোভে এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উচ্চতম বিত্তশালীর করভার লাঘব করে আর একজন যুদ্ধবাজ ‘রমণীয়’ নেতাকে বারাক ওবামার পাশাপাশি আদৌ সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে যে বিবেচনা করছিলেন, তা থেকেই বোঝা যায় যে, ধনবণ্টন বৈষম্যে মার্কিনরা সাধারণ ভাবে ততটা বিচলিত নয় (বরং কিছুটা গর্বিতই), যতটা ভারতের গড়পড়তা ভোটদাতারা উৎকট বৈষম্যের প্রতি অসহিষ্ণু। ১৩ অক্টোবরের ‘দি ইকনমিস্ট’ পত্রিকায় ‘যথার্থ প্রগতিবাদ’ নামে একটি তথ্য-প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে, গত তিন দশকে আমেরিকায় দেশের সব থেকে বড়লোক গোষ্ঠী, উচ্চতম ০.০১ শতাংশ, যারা জাতীয় আয়ের ১ শতাংশ ১৯৮০ সালে রোজগার করত, এখন তারাই জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ রোজগার করে। কিন্তু এর পরেই চিরাচরিত মার্কিন অর্থশাস্ত্রানুযায়ী মন্তব্য করা হয়েছে: ‘এটাও সত্যি যে, খানিকটা বৈষম্য একটা দেশের অর্থব্যবস্থার পক্ষে উপকারী। তাতে কর্মের প্রেরণা আরও ধারালো হয়, মানুষ ঝুঁকি নিতে শেখে, আর প্রতিভাশালী নবীন উদ্যোগ এতে পুরস্কৃত বোধ করে।’
তরুণ বঙ্কিমও ‘সাম্য’ গ্রন্থটির শুরুতেই বলে নিয়েছিলেন, ‘অতএব সংসার বৈষম্য পরিপূর্ণ।... তোমার অপেক্ষা আমি কথায় পটু বা আমার শক্তি অধিক বা আমি বঞ্চনায় দক্ষ, এ সকলি সামাজিক বৈষম্যের কারণ।... সংসারে বৈষম্য থাকাই উচিত।’
কিন্তু সাম্যাবতার শাক্যমুনি বুদ্ধ, সাম্যমূর্তি যিশুখ্রিস্ট এবং ‘তৃতীয় সাম্যাবতার রুশো’কে অবলম্বন করে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল: প্রাকৃতিক বৈষম্যকে ছাড়িয়ে অপ্রাকৃত কৃত্রিম বৈষম্য নীতিবিরুদ্ধ, ধর্মবিরুদ্ধ এবং শেষ পর্যন্ত মানবপ্রকৃতির পক্ষে হানিকর। ১৮৪৪ সালে (যখন বঙ্কিমের ছ’বছর বয়স) রচিত তরুণ মার্কসের ‘অর্থনৈতিকদার্শনিক পাণ্ডুলিপি’ বঙ্কিমচন্দ্র পড়েননি। কিন্তু শ্রমোপজীবীদের তথা কৃষক সম্প্রদায়ের সর্বহারা অবস্থার তুলনায় জমিদার ও বণিক সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মানের উৎকট অতিশয় যে ভারতবর্ষের অবনতির কারণ, এ কথা অত্যন্ত সূক্ষ্ম অর্থনৈতিক দর্শনের যুক্তি দিয়ে তিনি বুঝিয়েছিলেন। তিনটি বড় বড় কারণে শ্রমিকের হাতে ক্ষমতা না দিলে বৈষম্যের বিষবৃক্ষ পুষ্পিত হয়ে বিকটাকার ধারণ করে বলে বঙ্কিমচন্দ্রের বিশ্লেষণ। প্রথমত, পারিশ্রমিকের অল্পতা থেকে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করার জন্য দীর্ঘতর দৈনিক শ্রমকাল; দ্বিতীয়ত, এর ফলে অবকাশের ধ্বংস, যার মানেই হল বিদ্যাচর্চার অনবসর— অতএব মূর্খতা; তৃতীয়ত, অবসরভোগী অল্পসংখ্যক বুদ্ধি ও যশোভাগ্যবান উচ্চ শ্রেণির শিক্ষিত (অতএব মিথ্যাচারী) প্রভুত্ব এই ভাবে বৈষম্য বেড়েই চলে। জাতিবর্ণভেদ প্রথা এই ধন ও অস্ত্রবলের প্রাধান্যকে প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হলেও, শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য একজোট হয়ে শূদ্র ও অন্ত্যজ জাতির খাটুনির ফল বিনাশ্রমে উপভোগ করে বলেই তাদের শ্রমের বেতন কমাতে কমাতে নিজেদের আলস্য ও ভোগলালসার আগুনে তাদের আহুতি দিয়ে ‘সামগ্রিক’ ভাবে জাতীয় ‘উন্নতির’ কুহক বিস্তার করে যেতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্র রুশোর ভক্ত ছিলেন, যেমন ছিলেন ইমানুয়েল কান্ট। কিন্তু রুশোর অনেক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। সভ্যতার সবটুকুই খারাপ, আর ‘সামাজিক চুক্তি’র পূর্ববর্তী আদিম অ-সমাজবদ্ধ মুক্ত মানুষের সবটুকুই ভাল— এই আজগুবি কথাকে তিনি বলেছিলেন ‘রুশোর ভ্রান্তবাক্য’। কিন্তু ‘সেই ভ্রান্তবাক্য সাম্যাত্মক— সেই ভ্রান্তির কায়া অর্ধেক সত্যে নির্মিত’ (সাম্য, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)। আবার, ভারতীয় সমাজ, তার বৈষম্যসহনকারী অর্থকামে উদাসীন ধর্মমোক্ষপরায়ণ চরিত্রকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করলেও বঙ্কিমচন্দ্র সাম্যের মূল হিসেবে আর্যশাস্ত্রেরই বচন ‘আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ’— তারই সঙ্গে তুলনা করে লিখেছিলেন ‘‘দ্বিতীয় বার জেরুসালেমের পর্বতশিখরে দাঁড়াইয়া ইহুদিবংশীয় যীশু বলিলেন, ‘অন্যের নিকট তুমি যে ব্যবহারের কামনা কর, অন্যের প্রতি তুমি সেই ব্যবহার করিও।’’’
মহাভারতে বার-বার ধর্মের নানান লক্ষণ, নানাবিধ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব থেকে সংক্ষেপে ধর্মের লক্ষণ বলা হয়েছে ‘ন তৎ পরেষু সন্ধধ্যাৎ প্রতিকূলং যদাত্মনঃ।’— নিজে যা সহ্য করতে পারো না, তেমন আচরণ অন্যদের ওপর কোরো না। এই নীতির বিপরীত হল আমাদের স্বাভাবিক অহংকারঘটিত প্রতিযোগিতার প্রবৃত্তি। আমি বা আমার সন্তান প্রতিযোগিতায় বা চাকরির বাজারে হেরে যাব, তা আমি সহ্য করতে পারি না; কিন্তু অন্য লোক বা অন্যদের বাচ্চা আমার কাছে আর আমার সন্তানের কাছে হেরে যাক, এটা আমি শুধু চাই তা নয়, আমার সন্তানকেও শেখাই, ফার্স্ট হও, ওই সহপাঠীকে হারিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাও। প্রতিবেশীর যদি দু’টি শোবার ঘর থাকে, আমার যেন অন্তত চারটি শোবার ঘরযুক্ত বড়তর ফ্ল্যাট হয় সেই প্রার্থনা করে লক্ষ্মীপুজো করি। এই বৈষম্যবৃদ্ধিকারী হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতার ইন্ধনেই পুঁজিবাদী মুক্ত বাজার এগিয়ে চলে অগ্রগতির পথে। বর্তমান ভারতে হিন্দুত্বধ্বজাধারী নেতা— যিনি সংখ্যালঘুহত্যার মরণমহোৎসবে অভিযুক্ত হয়েও একের পর এক উচ্চ আদালতে দাঙ্গাবাজির অভিযোগ থেকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছেন, তিনিও একই সঙ্গে মহাভারতের আদর্শ এবং বাঁধনছাড়া মুনাফার বাণিজ্য-প্রশংসাকে ব্যবহার করে চলেছেন নির্বাচনী বক্তৃতার মালমশলা হিসেবে। অথচ মহাভারতে সত্যের তেরোটি আকার (‘সত্যাকারাস্ত্রয়োদশ’) বলতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছে ‘সমতা’র কথা। কেউ বলতেই পারেন, সুখদুঃখে, শত্রুমিত্রে, মান-অপমানে সমান ভাব রক্ষা করার ব্যক্তিগত স্থিতপ্রজ্ঞতার কথা বলা হচ্ছে এখানে, সামাজিক অর্থনৈতিক সমতার কথা নয়। কিন্তু মহাভারতের সার গীতা যখন সাম্যের কথা বলেছেন, তখন, পঞ্চম অধ্যায়ে ‘বিদ্যা বিনয় সম্পন্ন ব্রাহ্মণ’-এর সঙ্গে গরু ও হাতিকে, কুকুরের সঙ্গে কুকুরভোজী চণ্ডালকে সমান দৃষ্টিতে দেখার উপদেশই দেওয়া হয়েছে। পরের শ্লোকেই (ভগবদগীতা ৫/১৯) ‘এই মর্ত্যলোকেই তারা স্বর্গকে জয় করে যাদের মন সাম্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে, সম ব্রহ্মই নির্দোষ’, এই উক্তিকে সামাজিক সাম্যের সঙ্গে অসংবদ্ধ মনে করার কারণ নেই। ব্যাসদেবই তাঁর অন্য মহাপুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতে আরও স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন: ‘‘যতটুকু তার পেট ভরানোর জন্য দরকার, দেহধারী মানুষের ততটুকুতেই স্বত্বাধিকার, যে এর থেকে বেশি ধনে ‘অভিমান’ (‘এটা আমার, আর কাউকে দেব না’) মনে করে, সে চোর, তার শাস্তি হওয়া উচিত” (ভাগবত ৭/১৪)। লক্ষণীয়, ধনসৃষ্টি বা উৎপাদনে বা শিল্পসমৃদ্ধিতে কোনও সীমা টানা হচ্ছে না। ব্যক্তিগত মালিকানায়, স্বত্বাভিমানে, সীমা টানা হচ্ছে।
|
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই, মানোয়া’য় দর্শনের শিক্ষক |
(চলবে) |
|
|
|
|
|