আজ কলিকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। বিগত শতকের পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন হইত। সেটা ছিল রাজনীতির এক উত্তাল টালমাটালের যুগ। শিল্পকলা হিসাবে চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে সমাজের বিভিন্ন অংশের সহিত রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের আদানপ্রদানের, সংস্কৃতির বিভিন্ন প্রবণতার দ্বন্দ্ব ও ঘাতপ্রতিঘাতের প্রতিবিম্ব রূপে ব্যবহারের একটা প্রবণতা ছিল। পরবর্তী কালে তথাকথিত আর্ট ফিল্ম বনাম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের সীমারেখা মুছিয়া যায়, বক্তব্যপ্রধান, বিবৃতিসর্বস্ব চলচ্চিত্রও বিশুদ্ধ বিনোদনকে জায়গা ছাড়িয়া দেয়। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনও প্রাসঙ্গিকতা হারায়। এখনও চলচ্চিত্র উৎসব বলিতে যাহা অনুষ্ঠিত হয়, তাহার কার্যত স্রেফ বাজার, বিভিন্ন ছবির বাণিজ্যিক প্রচার এবং প্রদর্শন-স্বত্ব ক্রয়বিক্রয়ই যাহার মূল উপলক্ষ।
তবু যদি কোনও আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্রের ‘উৎসব’ আয়োজন করিতে চাহেন, তাহাতে দোষের কিছু নাই। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে তখন, যখন সরকার এ ধরনের তামাশার সাড়ম্বর আয়োজনে ব্রতী হয়। সরকারের কি কাজ ‘কম পড়িয়াছে’? বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের? স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কত কাজ যে অনারব্ধ পড়িয়া আছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। অধিকাংশ কাজই আবার অর্থাভাবেই শুরু করা যাইতেছে না। নানা ক্ষেত্রে সরকারি কর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়া যাইতেছে না, মহার্ঘ ভাতা বাকি পড়িতেছে, পেনশন বকেয়া থাকিতেছে। আর নুন আনিতে পান্তা ফুরায়, এমন সরকারের স্কন্ধ হইতে চলচ্চিত্র উৎসবের ভূত নামে না কেন? না কি, এ ধরনের সাড়ে সাতশো মজায় রাজ্যবাসীকে মজাইয়া রাখিয়া শাসকরা নিজেদের অকর্মণ্যতা হইতে তাঁহাদের নজর অন্যত্র ঘুরাইয়া দিতে ব্যগ্র? রুটি ও সার্কাসের সেই পুরানো কৌশল?
পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভাগ্য, ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও একজন চলচ্চিত্রবোদ্ধা বলিয়া গণ্য হইতেন। তিনি অবশ্য তথাকথিত আর্ট ফিল্ম-এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, নিম্নবর্গীয় জনরুচির প্রতি তাঁহার অবজ্ঞা সুপরিচিত। তাঁহার উত্তরসূরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও, হা কপাল, টলিউড-বলিউডের সহিত নিবিড় মাখামাখিতে বিশ্বাসী। চিৎপুরের যাত্রা-সংস্কৃতির প্রতিও তাঁহার প্রশ্রয়ের কথা সুবিদিত। তিনি টালিগঞ্জের কুশীলবদের সহিত ওঠা-বসা করিতে অভ্যস্ত, তাঁহার জনসভা ওই সব অভিনেতা-প্রযোজক-গায়ক-নটনটীরা আলো করিয়া রাখেন। চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা পুরোপুরি কোমর কষিয়া অবতীর্ণ। শোনা যায়, বলিউডের কোন কোন মহাতারকা উদ্বোধনে হাজির হইবেন, কে ‘থালি গার্ল’ হইবেন, অতিথি-অভ্যাগতদের তালিকায় কাহাদের নাম থাকিবে ইত্যাদি যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁহার সতর্ক নজর। স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গ আগামী পক্ষকাল সিনেমা-সিনেমা করিয়াই কাটাইয়া দিবে। মহাকরণ, লালবাজার, সচিবালয়, সব সরকারি দফতর, কোর্ট-কাছারি এ বার চলচ্চিত্র উৎসবে মাতিবে। কুনাট্যরঙ্গ অলীক নয়, কঠোর বাস্তব। |