রাজধর্ম কথাটি প্রাচীন। সাম্প্রতিক ভারতে এই শব্দ লইয়া আলোচনা শুরু হইয়াছিল ২০০২ সালে, যখন গুজরাতের সংখ্যালঘুনিধনের পরে নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে মন্তব্য করিতে গিয়া প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী রাজধর্মের প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন। তাহার পরে এক দশক অতিক্রান্ত। এই এক দশকে শব্দটি এই দেশে, বিশেষত এই রাজ্যে বহু বার বহু প্রসঙ্গে পুনরাবৃত্ত। তাহা দেশের বা রাজ্যের প্রশাসনের যন্ত্রীদের পক্ষে শ্লাঘার কারণ নহে। রাজধর্মের অনেক মাত্রা আছে, অনেক দাবি। কিন্তু তাহার মূলে যে আদর্শ, তাহা অত্যন্ত স্পষ্ট এবং সহজবোধ্য। সেই আদর্শের দুইটি প্রধান দিক। এক, শাসনের দায়িত্ব যাঁহাদের হাতে, তাঁহারা অন্যায়ের প্রতিকারে এবং প্রতিরোধে তৎপর থাকিবেন। দুই, শাসনের দায়িত্ব পালন করিতে গিয়া বা অন্য কোনও উপলক্ষে তাঁহারা নিজেরা অন্যায় আচরণ করিবেন না। দ্বিতীয় আদর্শ লঙ্ঘন করিলে অপশাসন বা কুশাসনের অপরাধ হয়, প্রথমটির লঙ্ঘনকে ‘অশাসন’ নামে অভিহিত করা চলে। সচরাচর সরকারের সমালোচনা হয় অপশাসনের কারণে। যেমন পুলিশ অন্যায় ভাবে কাহাকেও নিপীড়ন করিলে নিন্দিত হইয়া থাকে। সঙ্গত নিন্দা। কিন্তু অশাসনও রাজধর্মের পক্ষে কোনও অংশে কম হানিকারক নহে। পুলিশ বা প্রশাসনের যেখানে অন্যায় দমন করিবার কথা, সেখানে তাহারা নিষ্ক্রিয় থাকিলে রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হয়। প্রশাসনের দুষ্ক্রিয়তাও খারাপ, নিষ্ক্রিয়তাও খারাপ।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট জমানায় নন্দীগ্রামের গ্রামবাসীদের একাংশ সরকারের প্রতি বিরূপ হইয়া গ্রামে প্রবেশের পথ কাটিয়া ও প্রতিরোধ সৃষ্টি করিয়া এগারো মাস কার্যত ‘মুক্তাঞ্চল’ গড়িয়া রাখিয়াছিলেন, প্রশাসন সেখানে প্রবেশ করিতে পারে নাই। তাঁহাদের বিরূপতা কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল, তাহা অন্য প্রশ্ন। এগারো মাস পরে যে ভাবে সেই অঞ্চলটিকে প্রশাসন তথা শাসক দল ‘পুনর্দখল’ করে, তাহাও ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু প্রথম কথা ইহাই যে, রাজ্যের একটি এলাকাকে প্রশাসনের নিকট ‘অগম্য’ করিয়া রাখিবার এই উদ্যোগটিকে মানিয়া লইয়া প্রশাসন অন্যায় করিয়াছিল। ঠিক তেমনই, বীরভূমের লোবা গ্রামের অধিবাসীদের একাংশ, নিজেরাই হউক বা বহিরাগতদের সহযোগিতাতেই হউক, একটি বেসরকারি সংস্থার মূল্যবান যন্ত্র আবারও এগারো মাস আটকাইয়া রাখিয়াছেন, ইহা অন্যায়। শিল্পমন্ত্রী যদি সেই অনাচারের প্রতিকারে তৎপর হইয়া থাকেন, যন্ত্রটি উদ্ধারের জন্য প্রশাসনকে তৎপর হইতে বলিয়া থাকেন, ভাল করিয়াছেন। বিলম্বে হইলেও, অশাসনের অবসান ভাল।
অথচ যন্ত্র উদ্ধারের জন্য পুলিশি অভিযানের পরে সেই অভিযানের পরিপ্রেক্ষিত লইয়া বিচিত্র বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হইতেছে। প্রশাসন এবং পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্তা ও কর্ত্রীরা যেন তটস্থ ও সন্ত্রস্ত হইয়া যে যাহার দায় অস্বীকার করিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। পুলিশ কোনও অন্যায় করিয়াছে কি না, অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ করিয়াছে কি না, তাহা লইয়া নিশ্চয়ই প্রশ্ন থাকিতে পারে। প্রশ্ন গুরুতর হইলে যথাযথ তদন্তও জরুরি। বিনা অশান্তিতে, আপস-মীমাংসার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান হইলে শ্রেয় হইত, তাহাও বলা বাহুল্যমাত্র। রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষুদ্রস্বার্থের সাধনা বা সরাসরি দুর্নীতি সেই সমাধানের পথ রোধ করিয়াছে, এমন অভিযোগও আদৌ অযোক্তিক নয়। জমি অধিগ্রহণের নিয়ম ও পদ্ধতির সংস্কার জরুরি, তাহাতেও কোনও সংশয় নাই। কিন্তু কোনও যুক্তিতেই কেহ জোর করিয়া পরের দ্রব্য আটকাইয়া রাখিতে পারেন না, রাখিলে প্রশাসনকে তাহা উদ্ধার করিতে হয়, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করিতে হয়। ইহাই রাজধর্ম। সরকারি কর্তাদের আচরণ সেই ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীতে চলিতেছে। দীর্ঘদিন তাঁহারা অশাসনের অপরাধ করিয়াছেন। তাহার পরে যখন পুলিশ সক্রিয় হইয়াছে তখন আবার সেই সক্রিয়তার দায় লইতে অসম্মত হইতেছেন। ইহা কেবল রাজ্যের প্রশাসনিক ভাবমূর্তিতেই কলঙ্ক লেপন করে নাই, ইহার ফলে পুলিশ প্রশাসনের মনোবল ভাঙিয়া পড়িবার আশঙ্কাও প্রবল। তাহার পরিণাম, আক্ষরিক অর্থেই, ভয়ঙ্কর। পশ্চিমবঙ্গ মরূদ্যান ছিল না, কিন্তু তাহাকে একেবারে একশো শতাংশ মরুভূমি না বানাইলেই কি নয়? |