|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
অসুর নিধন করেই অশুভ শক্তি থেকে মুক্তির পথ |
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল দীপ্তি চক্রবর্তীর একক প্রদর্শনী ‘দুর্গা’। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে ‘দুর্গা’ শিরোনামে ক্যানভাসের উপর অ্যাক্রিলিক রঙে আঁকা ১৪টি ছবি নিয়ে একক প্রদর্শনী করলেন দীপ্তি চক্রবর্তী। যদিও ১৯৭০-এর দশক থেকে তিনি নিয়মিত ছবি আঁকছেন, তবুও এটিই তাঁর প্রথম একক। ভারতীয় চিত্ররীতি নিয়ে দীর্ঘ দিন চর্চা করছেন এই শিল্পী। কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে ১৯৭০-এ তিনি ভারতীয় চিত্ররীতিতে শিক্ষা শেষ করেছিলেন। তার পর দু’বছর ওখানেই পাশ্চাত্য চিত্ররীতিতে শিক্ষা নিয়েছেন। ফলে ভারতীয় চিত্ররীতির ঐতিহ্যগত আঙ্গিকের সঙ্গে তেলরং বা এখনকার অ্যাক্রিলিকের প্রকরণকে মেলাতে তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি। এমনকী রূপারোপে ঐতিহ্যগত পটরীতির সঙ্গে স্বাভাবিকতার অন্তর্গত ত্রিমাত্রিকতার প্রতিফলনকেও মিলিয়ে নিয়েছেন অনেক সময়। আলোচ্য প্রদর্শনীর কিছু ছবিতেও এর পরিচয় রয়েছে।
অজন্তার আঙ্গিক নিয়ে তিনি অনেক দিন কাজ করেছেন। অজন্তার ছবিতে বা ভারতের অন্যান্য কিছু ধ্রুপদী চিত্রে ভাস্কর্য সঞ্জাত এক ধরনের ত্রিমাত্রিক আয়তনময়তার বোধ কাজ করে। সেটা অবশ্য পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ-উত্তর অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতা থেকে একেবারেই আলাদা। আদর্শায়িত সৌন্দর্যের অনুরণন থাকে সেখানে, যা পার্থিবতার ভিতর অলৌকিকের আভাস আনে। আলোচ্য চিত্রমালায় অবশ্য অজন্তার রূপরীতি সেভাবে নেই। কিন্তু পটরীতি ও ধ্রুপদী রীতির সমন্বয় আছে।
আমরা যে দুর্গাপ্রতিমা দেখি, তাতে দুর্গাসম্পৃক্ত দু’টি ঐতিহ্য লক্ষ করা যায়। একটি আদিপরাশক্তির তমসানাশিনী দুর্গারূপ। অন্যটি পুত্র কন্যা সহ মাতা-উমার পরিবার কেন্দ্রিক রূপ। পরাশক্তিরূপিণী দানবদলনী দুর্গা ভীষণা। অসুর নিধন করে বিশ্বকে অশুভ শক্তি থেকে মুক্ত করা তাঁর দায়। আর মাতৃরূপিণী উমা প্রসন্না। ভীষণ ও প্রসন্ন এই দুই রূপের সমাহার থাকে দেবী দুর্গার রূপায়ণে। আমরা লক্ষ করি দেবী যখন অসুরকে ত্রিশূল বিদ্ধ করছেন, তখনও তাঁর চোখের দৃষ্টি প্রসন্ন ও প্রেমময়। |
|
শিল্পী: দীপ্তি চক্রবর্তী |
আমাদের দেশে খ্রিস্টপূর্ব তিন থেকে দুই সহস্রাব্দের টেরাকোটায় মাতৃমূর্তির রূপায়ণ পাওয়া গিয়েছে সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত হরপ্পায়। এই মূর্তিই নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকের যক্ষী মূর্তিতে এসে পৌঁছেছে। ক্রমান্বয়ে এই পরাশক্তি দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি নানা রূপে বিকশিতা হয়েছেন। দুর্গামূর্তি হয়ে উঠেছে একটি প্রতীককল্প। চিত্র-ভাস্কর্যের একটি বিশেষ বিষয়, যে মূলগত রূপকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্ন ভাবে রূপান্তরিত করেছেন। বিভিন্ন লৌকিক পট ও কালীঘাটের পটে আমরা দেবী দুর্গার এক ধরনের রূপ দেখি। আবার প্রাক্-আধুনিক অনামা শিল্পীদের তেলরঙের ছবিতে দেখি তাঁর আর এক রূপ। ১৯৪০-এর দশক পরবর্তী শিল্পীরা রামকিঙ্কর, নীরদ মজুমদার থেকে সাম্প্রতিকের ধীরেন্দ্রনাথ ব্রহ্ম, দীপেন বসু থেকে গণেশ পাইন, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য, শক্তি বর্মন প্রমুখ শিল্পী পর্যন্ত এই শক্তি ও মাতৃরূপিণী মূর্তির বিভিন্ন প্রকাশ আমরা দেখেছি।
দীপ্তি চক্রবর্তী শক্তিরূপিণী দেবীর বিভিন্ন রূপ এঁকেছেন। ঘরের মেয়ে মাতৃরূপিণী উমার রূপ তিনি আঁকেননি। প্রতিটি ৩৬ বাই ৩০ ইঞ্চি আকারের আয়তাকার ক্যানভাসে তিনি চণ্ডীর পুরাণকল্প অনুসরণ করে তাঁর ১৪টি মূর্তি রূপায়িত করেছেন। ‘শিবদূতী মহাষলা’তে দেখি আয়তনয়না দুর্গা অসুরের বুকে ত্রিশূল বিদ্ধ করেছেন। ‘শ্বেতরূপধরা দেবী’তে দেবীর এক হাতে যদিও অসি রয়েছে তবু কোনও যুদ্ধ পরিস্থিতি নেই। বরং দেবীর অন্য দু’হাতে সৌন্দর্য ও জ্ঞানের প্রতীক ধরা আছে। ‘ব্রাহ্মী হংসসমারূঢ়া’তে রয়েছে জলের উপর হংসবাহিনী দেবীমূর্তি। ‘প্রেতসংস্থাতু চামুণ্ডা’তে শায়িত শিবের বুকের উপর মুণ্ডমালিনী কালীকে দেখা যাচ্ছে। ‘লক্ষ্মী: পদ্মাসনা দেবী’তে দুর্গা কমলায় রূপান্তরিত হয়েছেন। ‘বৈষ্ণবী গরুঢ়াসনা’তে বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন দুর্গা। ‘নারসিংহী মহাবীর্যা’তে দেখা যাচ্ছে নৃসিংহ অবতারের রূপ।
এরকম ১৪টি রূপ এঁকেছেন শিল্পী। তাঁর রূপায়ণ খুবই সংহত ও বর্ণময়। কিন্তু কিছু সমস্যা ভারাক্রান্ত করেছে তাঁর রূপায়ণকে। কোথাও কোথাও তাঁর রেখারূপে সূক্ষ্ম স্পন্দনের অভাব ঘটেছে। এ ছাড়া চিত্রপট এত ঘনসংবদ্ধ যে অনেক ক্ষেত্রেই পরিসরগত অবকাশের অভাব থেকে গিয়েছে। মূর্তিকল্প আরও একটু ধ্যানের ঐকান্তিকতা চাইছিল। |
|
|
|
|
|