বিবিধ পরিচিতির বহুত্বকে দমন করিয়া কোনও একটি পরিচিতিকে একমাত্র বা প্রধান বলিয়া গণ্য করিলে কী ঘটিতে পারে, অথর্নীতি ও দর্শনের পণ্ডিত অমর্ত্য সেন ‘আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স’ গ্রন্থে তাহার অসামান্য আলোচনা করিয়াছেন। আফ্রিকার রোয়ান্ডা নামক দেশটিতে দুই প্রধান জনজাতির বহু মানুষ তাঁহাদের অন্য সব পরিচয় ভুলিয়া নিজেদের ‘হুটু’ বনাম ‘টুটসি’ পরিচয়ের দ্বৈতবাদে নির্দিষ্ট করিবার পরিণামে লাখ দশেক প্রাণ বিনষ্ট হইয়াছিল, সেই বৃত্তান্ত তিনি সভয়ে স্মরণ করেন। স্মরণ করেন দেশভাগের পূর্বাপর ভারতে হিন্দু বনাম মুসলমান দাঙ্গার অভিজ্ঞতাও। তাঁহার আলোচনায় আরও নানা দৃষ্টান্ত ছিল। পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষত কলিকাতার বিদ্বজ্জনদের ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’ লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত ছিল না। আজ গ্রন্থটি লিখিত হইলে হয়তো থাকিত। রক্তপাত হয় নাই, আশা করা যায় হইবেও না, কিন্তু বিনা রক্তপাতেও দুই শিবিরের দ্বন্দ্ব কোন প্রবল আকার ধারণ করিতে পারে, তাহা গত কয়েক বছরে বঙ্গসমাজ বিস্ফারিতনয়নে অবলোকন করিতেছে। রাজনীতির শিবির-বিভাজন সুপরিচিত ছিল, স্বাভাবিকও। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক আনুগত্যপ্রসূত পরিচয়ই সকল পরিচয়ের ঊর্ধ্বে স্থান পাইল, বিদ্বৎসমাজ সেই রাজনৈতিক বিভাজনরেখা ধরিয়াই আড়াআড়ি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়িলেন, সমস্ত প্রসঙ্গ এমনকী গুন্ডাদের হাতে নাট্যকর্মীর লাঞ্ছনার প্রতিবাদও সেই বিভাজনের শিকার হইয়া পড়িল, ইহা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, ভয়ঙ্কর।
এই পরিণতির জন্য দায়ী কে? রাজ্যের দুই প্রধান শিবিরের রাজনীতিকরাই এই বিভাজনকে লালন করিয়া চলিয়াছেন। এবং আজ নহে, বহু কাল ধরিয়াই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিভাজনের স্রষ্টা নহেন, এমনকী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও সেই সম্মান দেওয়া চলে না। তাঁহার পূর্বপ্রজন্মের বামপন্থীরা কার্যত পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির আদিপর্ব হইতেই এই বিভাজনের স্রষ্টা এবং পালক। বর্তমান শাসকরা আর পাঁচটি ক্ষেত্রে যেমন বামপন্থীদের মহান উত্তরসূরির স্বীকৃতি পাইয়াছেন, তাঁহারা ‘আমরা-ওরা’-র ঐতিহ্যও বহন করিয়া চলিতেছেন, এইমাত্র। কিন্তু রাজনীতি স্বভাবেই এমন। বিভাজনই তাহার স্বধর্ম। প্রশ্ন হইল, বিদ্বজ্জনরা সেই ধর্ম অনুসরণ করিবেন কেন? প্রকৃত বিদ্বজ্জনের স্বধর্ম তো রাজনীতির মুখ চাহিয়া তৈয়ারি হইতে পারে না। তাঁহার যদি কোনও ধর্ম তাকে, তাহার নাম স্বাতন্ত্র্য। চিন্তার স্বাতন্ত্র্য, কর্মের স্বাতন্ত্র্য, বিচারবুদ্ধির স্বাতন্ত্র্য। এবং স্ব-তন্ত্র বলিয়াই, বিদ্বজ্জনরা রাষ্ট্রশক্তি তথা ক্ষমতাবানের অন্যায়ের প্রতিবাদে সতত সচেতন থাকিবেন, ইহাই প্রত্যাশিত। আবার প্রতিবাদী ভূমিকার স্বার্থেই তাঁহারা সমস্ত শিবির হইতে দূরে থাকিবেন, ইহাও বাঞ্ছনীয়। পশ্চিমবঙ্গে বিদ্বজ্জনদের একটি বড় অংশ অনেক কাল যাবৎ এই স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেন নাই। তাঁহারা দলীয় শিবিরে নাম লিখাইয়াছেন। এই বিষয়ে ‘বামপন্থী’ বুদ্ধিজীবীদের দীর্ঘ ইতিহাস স্মরণীয়। মতামতের প্রশ্নে কে বামপন্থী, কে নহেন, তাহা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু মতামত যাহাই হউক, বিদ্বজ্জন কোনও সংগঠিত দলের অনুগামী হইলে কী হয়, তাহার বহু নমুনা বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গ দেখিয়াছে। সুস্থ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়া পণ্ডিত বা কৃতী ব্যক্তিরা দলদাসের ন্যায় আচরণ করিয়াছেন। ইহার বীজ উপ্ত হইয়াছিল অনেক আগেই: ১৯৪১-৪২’এর ‘জনযুদ্ধ’ হইতে ১৯৫৬’র হাঙ্গারি বা ১৯৬৮’র চেকোস্লোভাকিয়া বামপন্থী বুদ্বজ্জন আপন বিদ্যাবুদ্ধি শিকেয় তুলিয়া দল তথা মস্কোর নির্দেশ পালন করিয়াছেন। বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গে, দীর্ঘ ক্ষমতার কল্যাণে, ইহারই এক চরম রূপ দেখা গিয়াছে। বিদ্বজ্জনরা যদি আপন স্বাতন্ত্র্যের পূর্ণ মর্যাদা দিয়া এই দল, ওই দল, সব দল হইতে দূরে দাঁড়াইতেন, তাহাই হইত প্রকৃত পরিবর্তন। তাহা হয় নাই, বরং শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায়, সিপিএমত্ব’র বিপ্রতীপে তৃণমূলত্ব প্রোথিত হইয়াছে, কারণ ‘এটাই বাস্তব’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণার্থে প্রস্তাবিত সভায় যদি এই বাস্তব বদলায়, ‘সংস্কৃতি সমন্বয়’ মঞ্চ যদি আপন নামের মর্যাদা রক্ষা করিতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ তাহার বিদ্বজ্জনদের অভিবাদন জানাইবে। সর্বজনীন অভিবাদন। |