কাঁটাতারের দু’পাশ থেকেই দেখা হল আত্মীয় স্বজনদের
বৃদ্ধ বাবা মেয়েকে দেখলেন দশ বছর বাদে। ভাইয়ের সঙ্গে দিদির দেখা হল বছর কুড়ি পরে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর এক প্রৌঢ়া চিনতে পারলেন তারকাঁটার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কতদিন আগে দেখা বোনপোকে।
ঈদুজ্জোহার পরের দিন রবিবার দিনভর এ ভাবেই যেন মিলনমেলার চেহারা নিয়েছিল মুরুটিয়ার পাকশি কিংবা বেড়রামচন্দ্রপুর সীমান্ত। তারকাঁটার বেড়ার দু’ধার ঘেঁষে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ভিড় জমিয়েছিলেন দুই বাংলার অন্তত কয়েক হাজার মানুষ। নিয়মের অনুশাসন কিংবা বিএসএফের ভারি বুটের আওয়াজ ছিল না। সীমান্তের রোজ দিনের সেই চেনা চেহারাও এদিন ছিল অনেকটাই ম্লান। বরং সারা বছর ধরে সীমান্তের নানা সমস্যায় জর্জরিত কাঁটাতারের দুপারের আটপৌরে মানুষ এ দিন ছিলেন উৎসবের মেজাজে।
শিকারপুর এলাকায় মাথাভাঙা নদীতে দশমীর বিকেলে প্রতিমা বিসর্জন হয়। সেই প্রতিমা নিরঞ্জন দেখতে নদীর দু’পাড়ে ভিড় করেন দুই বাংলার মানুষ। বসে মেলাও। ওপারের কোন আত্মীয়র জন্য তিরতিরে মাথাভাঙাতে জিলিপি ভর্তি হাঁড়ি ভাসিয়ে দেন এপারের মানুষ। ওপার বাংলার আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার, কথা বলার জন্য এই দিনটিকেই বেছে নেন এপার বাংলার মানুষ। দশমীর দুপুরে দূরদুরান্ত থেকে এসে নদীর দুপারে ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। এমনটাই দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে, এ বারেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। তবে ঈদ্দুজোহার পরের দিন পাকশি সীমান্তে যা হল, সেটা অনেকটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো। পিপুলবাড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কংগ্রেসের মোজ্জাফ্ফর সেখ বলেন, “এমনটা প্রতিবার হয় না। তবে এ বার বিএসএফকে বলে কোনও মতে রাজি করানো গিয়েছিল। দিনকয়েক আগে সীমান্তে বিএসএফের এক পদস্থ কর্তা এসেছিলেন, তাঁকে আমরা বারবার অনুরোধ করাতে তিনি রাজি হয়েছিলেন। তাই এটা সম্ভব হল।” তবে তারকাঁটার গায়ের কোনও গেট খোলা হয়নি। দেখা করা, কথা বলা যা হয়েছে, তা সবটাই কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে। পাকশির উজ্জ্বল সেখ বলেন, ‘‘এটাই বা কম কী বলুন? এমন দিন তো আর রোজ আসে না, কতদিন বাদে আমার মামার সঙ্গে দেখা হল। তাঁকে আমার ফোন নম্বর দিয়েছি। এবার ফোনে অন্তত কথা তো বলতে পারব। অন্য বারের তুলনায় এ বারের ঈদ সত্যিই আমার কাছে অন্যরকম।”
পাকশি সীমান্তে গেলে ওপারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করা যাচ্ছে, সীমান্তছোঁয়া গ্রামগুলিতে এই বার্তা ছড়িয়ে যায় বিদ্যুৎ গতিতে। সাইকেল, মোটরসাইকেল, ভ্যান, ম্যাটাডোর এমনকী গাড়ি ভাড়া করে পিলপিল করে লোক জমতে শুরু করে পাকশি সীমান্তে কাঁটাতারের দুধারে। শুধু কালো মাথার ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যেই দেখা হল কতদিনের না দেখা কোনও প্রিয়জনকে। বলা হল কতদিনের না বলা জমানো কত কথা। কেউ কাউকে ছুঁতে পারলেন না ঠিকই, তবে চলল বিস্কুটের প্যাকেট, লজেন্স কিংবা মিষ্টির প্যাকেট লেনদেন।
আরবপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন নইমদ্দিন সেখ। ওদিকে বাংলাদেশের মেহেরপুরের তেঁতুলবেড়িয়া থেকে এসেছিলেন নইমদ্দিনের শ্যালক ও শাশুড়ি। দীর্ঘদিন বাদে দেখা হল তাঁদের। বাংলাদেশের নাহারুল বলেন, ‘‘কতদিন পর দিদি, জামাইবাবুকে দেখলাম আমরা গরিব মানুষ ভিসা, পাসপোর্ট করার সার্মথ্য আমাদের নেই। তাই দেখা সাক্ষাৎ করার ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠে না। এ ভাবে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগছে। আবার কবে দেখা হবে কে জানে?’’
সীমান্তছোঁয়া দুই দেশের গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন বহু আত্মীয় পরিজন। সীমান্তে এত কড়াকড়ি যখন ছিল না, তখন দুদেশের মধ্যে যাতায়াত, বিয়ে সবই হত।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলে গেল সীমান্ত। বন্ধ হয়ে গেল যোগাযোগও। কাঁঠালিয়া থেকে ছুটে এসেছেন বছর আশির প্রৌঢ়া কারিমন বেওয়া। তিনি বলেন, ‘‘এত সব নিয়ম কানুন হবে জানলে কি আর ও দেশে মেয়ের বিয়ে দিতাম রে বাবা? কতদিন ওকে দেখিনি। এই ভিড়ের সঙ্গে যদি ও এসে থাকে তাহলে মরার আগে একবার অন্তত চোখের দেখা দেখে যেতে পারব।” ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যান কারিমন। সেই ভিড় থেকে ভেসে আসে অজস্র সংলাপ। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে মিষ্টির প্যাকেটটা দিতে গিয়ে ছড়ে যায় অনভ্যস্ত হাত। উদ্বিগ্ন হয়ে ওপার থেকে কেউ এগিয়ে দেন কাপড়ের টুকরো। এইসব টুকরো টুকরো অসংখ্য দৃশ্যের ভিড়ে শেষ বিকেলেও চকচক করে ওঠে নিঃসঙ্গ কাঁটাতার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
Nationa• | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.