|
|
|
|
লক্ষ্মী-সরস্বতীর যুগল আরাধনা কোজাগরীতে
কিংশুক গুপ্ত • বিনপুর |
কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে লক্ষ্মীদেবীর আরাধনায় মেতে ওঠেন বাংলার আপামর মানুষ। এরই মধ্যে বিনপুরের হাড়দা গ্রামের ছবিটা একটু ভিন্ন। গ্রামের ‘মোড়ল’দের পারিবারিক লক্ষ্মীপুজোয় সঙ্গে আরাধনা করা হয় সরস্বতীরও। পাশাপাশি, লক্ষ্মীপতি নারায়ণ ও দুই দেবীর চারজন সখীও পূজিত হন। হাড়দা গ্রামের ‘মণ্ডল-বাকুল’-এর এই পারিবারিক পুজোর এ বার সার্ধশত বর্ষপূর্তি। তাই এ বার বাড়তি জাঁক। সাত দিন ধরে চলবে নানা অনুষ্ঠান।
জনশ্রুতি, বহু বছর আগে হাড়দার শুঁড়ি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা গ্রামের সম্পন্ন ‘মোড়ল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাই ওই পরিবার গুলিকে ‘মণ্ডল-বাকুল’ বলা হতো। লোকশ্রুতি, ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে গ্রামের অক্রুর মোড়ল স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মণ্ডল-বাকুলের পারিবারিক কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো শুরু করেন। দেড়শো বছর আগে মণ্ডল-বাকুলের অধীনে ৬০টি পরিবার ছিল। এখন গ্রামে মণ্ডল-বাকুলের ২৫১টি পরিবার ছাড়াও গ্রামে আরও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাস। তবে, পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে কেবলমাত্র মণ্ডল-বাকুলভুক্ত পরিবার। আগে খড়ের ছাউনির মাটির ঘরে পুজো হতো। বছর দু’য়েক হল স্থায়ী পাকা লক্ষ্মী মন্দির তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছর একই কাঠামোর উপর মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরি করা হয়। এক চালচিত্রে লক্ষ্মীর বাঁ দিকে থাকেন সরস্বতী। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর দু’পাশে দু’জন করে মোট চারজন সখি থাকেন। তাঁদের বলা হয় ‘লুক-লুকানি’। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মাথার উপর থাকেন পীতবসন ধারী চৈতন্যস্বরূপ নারায়ণ। |
|
ছবি: দেবরাজ ঘোষ। |
কেন লক্ষ্মী ও সরস্বতী এক সঙ্গে পূজিত হন? আয়োজকদের বক্তব্য, বিষ্ণু পুরাণ মতে, নারায়ণের দুই স্ত্রী হলেন লক্ষ্মী ও সরস্বতী। সম্ভবত, সেই কারণে নারায়ণের সঙ্গে তাঁর দুই স্ত্রী-র পুজো করা হয়। ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অবশ্য মন্তব্য, “হাড়দায় সপার্ষদ লক্ষ্মীকে শাস্ত্রীয় মতে পুজো করা হলেও সম্পদ ও জ্ঞান রূপা দুই দেবীর সহাবস্থানের বিষয়টি লৌকিক ভাবনা প্রসূত।”
পুজো কমিটির সম্পাদক সিন্টু সাহা জানান, হাড়দার লক্ষ্মীপুজোর জাঁক দুর্গাপুজোর চেয়েও অনেক বেশি। মণ্ডল-বাকুলের যে সব সদস্যরা গ্রামের বাইরে থাকেন, তাঁরাও এই পুজো উপলক্ষে গ্রামে আসেন। কোজাগরীর সন্ধ্যায় সমবেত শঙ্খধ্বনি ও হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে শোভাযাত্রা করে গ্রামের মণ্ডল দিঘিতে ঘটের জল ভরতে যাওয়া হয়। বংশানুক্রমিক পূজারী ব্রাহ্মণ পুজো করেন। দেবীকে মূলত ছোলার বেসন থেকে তৈরি বুটের নাড়ুর ভোগ দেওয়া হয়। প্রথমে ঘিয়ে ভেজে নেওয়া হয় বেসনের ঝুরি। তারপর ঘন চিনির রসে সেই ঝুরি মিশিয়ে তৈরি করা হয় গোলাকার নাড়ুগুলি। দেবীর অন্নভোগ হয় না। তবে লুচি ও সুজি নিবেদন করা হয়। প্রতিপদের ভোরে পুজো শেষ হয়। হাড়দার লক্ষ্মীপুজোর মেলায় কেবলমাত্র প্রতিপদের দিনে চালগুঁড়ি ও বিউলি ডাল গুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা হয় এক অনন্য স্বাদের জিলিপি। তৃতীয়ার দিনে ঘট বিসর্জন হয়। তারপর আগামী ৫ নভেম্বর কৃষ্ণপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হবে। এবার ১৫১তম বর্ষের পুজোর বাজেট ৪লক্ষ টাকা। পুজো উপলক্ষে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, দু’রাত যাত্রা ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। থাকছে চন্দননগরের আলোকসজ্জা।
এ বারও লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে মণ্ডল-বাকুলের সদস্য খড়্গপুরের হিজলি হাইস্কুলের শিক্ষক অশেষকুমার সাহা, বর্ধমানের সাংসদ অনুপকুমার সাহা, অনুপবাবুর স্ত্রী বর্ধমান পুরসভার ভাইস চেয়ার পার্সন তনুশ্রী সাহা, ওড়িশা রাজ্য সরকারের উচ্চ পদস্থ সচিব প্রদীপ্তরঞ্জন সাহা-রা হাড়দায় এসেছেন। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য, “গ্রামের পারিবারিক লক্ষ্মীপুজোকে ঘিরে আমরা শারদোৎসবের আনন্দে মেতে উঠি।” |
|
|
|
|
|