|
|
|
|
তিন বার হানা দুষ্কৃতীদের |
অপহরণ সত্ত্বেও পুলিশ বলছে অবস্থা স্বাভাবিক |
দেবমাল্য বাগচি • হলদিয়া |
মাস দু’য়েক ধরে টাউনশিপের শঙ্খিনী আবাসনে কামিনী ২-বি ফ্ল্যাটে স্ত্রী এবং এক বছরের মেয়েকে নিয়ে রয়েছেন এবিজি-র জেনারেল ম্যানেজার (টেকনিক্যাল) ভূষণ পাটিল। দিন কয়েক ধরে তাঁদের বাসায় রয়েছেন জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) ক্যাপ্টেন মনপ্রীত জলি ও ম্যানেজার (অপারেশন) জগদীশ বেহরা। এবিজি-র অভিযোগ, শনিবার রাত ১১টা নাগাদ হঠাৎই ওই আবাসনে চড়াও হয় পাঁচ দুষ্কৃতী।
প্রথম বার অবশ্য আবাসনের নিরাপত্তারক্ষীদের বাধায় ফিরতে হয় দুষ্কৃতীদের। এর পরে আরও বড় ঘটনা ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় সঙ্গে সঙ্গে ওই নিরাপত্তারক্ষীরা ঘটনার কথা জানান হলদিয়া থানায়। এক ঘণ্টা বাদে আবার হানা। এ বার দলে ভারী দুষ্কৃতীরা। এ বারও লক্ষ্য তিন তলার ওই একই ফ্ল্যাট। তবে এর মধ্যে পুলিশ এসে গিয়েছে। সুতরাং দুষ্কৃতীরা আবার ফিরে যায়। রাত একটা নাগাদ চলে যায় পুলিশ। এই সময়টার জন্যই বোধহয় অপেক্ষা করছিল দুষ্কৃতীরা। পুলিশ চলে যেতেই আবার চড়াও হয় তারা। এ বার সংখ্যায় আরও অনেক বেশি। দরজা ভেঙে এবিজি-র তিন কর্তা ও ভূষণবাবুর স্ত্রী-কন্যাকে তারা তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ।
আবাসনের নিরাপত্তারক্ষী পরিমল পাত্রের কথায়, “তিন বার এসেছিল ওরা। মাঝে পুলিশ এসে আমায় গেট বন্ধ করে রাখতে বলেছিল। কিন্তু ওরা গেট ভেঙে ঢোকে। সংখ্যায় ওরা ছিল অনেক বেশি। হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। অন্ধকারে কাউকেই চিনতে পারিনি।” এবিজি-র বক্তব্য, দুষ্কৃতীরা মাঙ্কি ক্যাপ ও মাফলারে মুখ ঢেকে এসেছিল।
যে আবাসনটিতে এই ঘটনা ঘটেছে, সেটা হলদিয়া থানা থেকে শ’দুয়েক মিটার দূরে। সেখানে দফায় দফায় হানা এবং তার পরে অপহরণের ঘটনা রীতিমতো ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দিয়েছে হলদিয়াবাসীদের মেরুদণ্ড দিয়ে। সঙ্গে যোগ হয়েছে শহরে এবিজি বিরোধী বিক্ষোভ। বন্দরে এ দিন পুলিশ পিকেট বসে। কিন্তু এলাকার বাইরে রানিচক মোড়ে অবস্থান-বিক্ষোভে বসেন ছাঁটাই শ্রমিকরা। রানিচক থেকে সিটি সেন্টার হয়ে গাঁধীনগর পর্যন্ত মিছিল করা হয়। স্লোগান ওঠে ‘এবিজি দূর দূর হঠাও’। হলদিয়া মহকুমা পুলিশ অবশ্য এর পরেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলেই বিবৃতি দিয়েছে। আর তাদের এই ভূমিকায় নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা বেড়েছে সাধারণ মানুষের।
আতঙ্কিত হলদিয়ার সিপিএমের পুরপ্রধান তমালিকা পণ্ডা শেঠও। তাঁর অভিযোগ, “হলদিয়ার আগের সেই সংস্কৃতি আর নেই। পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে না, বা করতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি সামান্য পুরপ্রধান। আমার কথায় কি প্রশাসন চলবে?” এলাকার কাউন্সিলর তথা হলদিয়া পুরসভার বিরোধী দলনেতা তৃণমূলের দেবপ্রসাদ মণ্ডল অবশ্য এই অপহরণ-কাণ্ডে ছাঁটাই শ্রমিকদের দায়ী করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “এবিজি শ্রমিক ছাঁটাই করেছে। তাঁরাই এই সব ঘটনা ঘটাচ্ছেন। রাস্তা আটকাচ্ছেন। অবস্থান করছেন। আমরা পুলিশে জানিয়েছি। পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
শিল্পশহরের নদীপাড়ের টাউনশিপ নিরাপদ বলেই এত কাল ধারণা ছিল এলাকাবাসীর। সেখানকারই শঙ্খিনী আবাসনে পরপর তিন বার হামলা হয় শনিবার গভীর রাতে। তিন বন্দর আধিকারিক এবং এক জনের স্ত্রী-কন্যাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। রবিবার সকালেও থমথমে ছিল এলাকা। আশপাশের এলাকার কয়েক জন এই নিয়েই আলোচনা করছিলেন নিচু স্বরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রৌঢ়ের গলায় ঝরে পড়ে দুশ্চিন্তা, “চূড়ান্ত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। উৎসবের মরসুমে এমনিতেই আবাসনের অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। তার উপর যখন-তখন হামলা। আমাদের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে।”
শঙ্খিনী আবাসনের ভিতরেও একই আলোচনা। আবাসনের গাড়ির চালক দীপক দাস বলেন, “রাতে আমি নীচেই শুয়েছিলাম। হঠাৎ দুষ্কৃতীরা চড়াও হয়। আমরা পুলিশে জানিয়েছিলাম। পুলিশ আসতে চলে গিয়েছিল ওরা। পরের বার যখন এল, তখন আর ভয়ে বেরোইনি। বুঝতে পারছিলাম দরজা ভাঙছে। কিছু করার ছিল না। ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।” রাতের নিরাপত্তারক্ষী পরিমল পাত্রকে সকালে আবাসনে পাওয়া যায়নি। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “শেষ বার যখন ওরা এল, তখন ছাদে চলে গিয়েছিলাম। এখনও ভাবলে শিউরে উঠছি। পুলিশকে সবই জানানো হয়েছিল। পুলিশ আসেনি।”
কামিনী টু-বি ফ্ল্যাটের পাশেই থাকেন একটি ভোজ্য তেল প্রস্তুতকারী সংস্থার আধিকারিক মনীশ কুমার। তাঁর চোখে-মুখে আতঙ্কের রেশ কাটেনি এ দিন সকালেও। তিনি বলেন, “আমার ঘরেও ওরা ডাকাডাকি করেছিল। আমিও বেরিয়েছিলাম। তবে নাম জানার পরে আমাকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে বলে। রাতে আর ঘুম হয়নি। সব শুনতে পাচ্ছিলাম।”
হলদিয়া বন্দরে হুমকি-মারধরের ঘটনা নতুন নয়। গত এক মাস ধরেই ২ এবং ৮ নম্বর বার্থে কাজ করতে পারছে না পণ্য খালাসের দায়িত্বে থাকা এবিজি। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বন্দরে কাজ করতে গিয়ে এবিজি-র ছাঁটাই শ্রমিকদের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে হাসপাতালে যান এবিজি-র ‘শিপ লিডার’ সুব্রত মণ্ডল ও এক ‘ক্রেন অপারেটর’। তারও আগে বন্দরের আধিকারিক রমাকান্ত বর্মনকে অপহরণের অভিযোগ উঠেছিল। তার পরে শনিবার রাতের ঘটনা। এক শ্রমিকের কথায়, “রানিচক মোড়ে তৃণমূলপন্থী শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। কাজে যেতে চাইলে ওই মোড় দিয়েই যেতে হবে। সেখানে মারধর খেলে কেউ দেখার নেই।”
এর পরেও মহকুমা পুলিশ আধিকারিক অমিতাভ মাইতির বক্তব্য, পরিস্থিতি স্বাভাবিক।
|
|
|
|
|
|