কলিকাতা পুরসভাকে নাগরিকরা মুক্তকণ্ঠে ‘শুভ বিজয়া’ জানাইতে পারেন। তাহার কারণ, দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের পরে দ্রুত, অতি দ্রুত ভাগীরথীর জল এবং সন্নিহিত স্থলভূমি হইতে যাবতীয় ধ্বংসাবশেষ সাফ করিয়া ফেলা হইয়াছে। কলিকাতাকে লন্ডন করিতে সঙ্কল্পবদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী নদীতীর পরিভ্রমণ করিয়া যদি কলিকাতার মেয়রের প্রতি প্রীতিপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া ‘আমার চোখে তো সকলই শোভন’ গাহিয়া ওঠেন, পুরবাসী তাঁহার সুরে সানন্দে সুর মিলাইবেন। এই সাফল্য এক দিনে আসে নাই। বেশ কিছু বছর ধরিয়াই প্রতিমা বিসর্জনের ফলে নদীর যে দূষণ ঘটে, তাহার প্রতি পরিবেশবাদীদের দৃষ্টি পড়িয়াছে। উদ্যোগীরা এই দূষণের মাত্রা যাচাই করিতে নানাবিধ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা চালাইয়াছেন, প্রমাণ করিয়াছেন যে, প্রতিমা নিরঞ্জনের ফলে সত্যই জলের দূষণ ঘটিতেছে। ক্রমশ সমাজ সচেতন হইয়াছে, আদালতের কঠোর দৃষ্টি প্রশাসনকেও সচেতন হইতে বাধ্য করিয়াছে, বিসর্জনের আয়োজন ক্রমশ উন্নততর হইয়াছে। ফুল, পাতা, অন্যান্য উপকরণ ইত্যাদি আগে যে ভাবে জলে ফেলিয়া দেওয়া হইত, তাহা বন্ধ হইয়াছে। তাহার পরে প্রতিমা নিরঞ্জনের পরেই তাহা তুলিয়া আনিবার ব্যবস্থা প্রচলিত হইয়াছে। এ বছর সেই বন্দোবস্তই আরও সুগঠিত, আরও তৎপর ছিল। ইহা কেবল পরিবর্তন নয়, উন্নততর পশ্চিমবঙ্গ হইবার
পথে পরিবর্তন।
এবং সেই কারণেই প্রশ্ন ওঠে, উন্নতি এখানে থামিবে কেন? যে যুক্তিতে, যে কারণে প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থাটির সংস্কার ঘটিতেছে, সেই যুক্তিতে, সেই কারণেই নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের রীতিটিই বন্ধ করা উচিত। সত্য, বহু কাল ধরিয়া এই রীতি চলিয়া আসিতেছে। সত্য, ইহার সহিত ধর্মীয় আচার এবং লোকবিশ্বাস জড়াইয়া আছে। কিন্তু বিশ্বাস, আচার, ঐতিহ্য ইহাদের কোনওটিই তো অ-পরিবর্তনের কৈফিয়ত হইতে পারে না। শেষ বিচারে, ধর্মীয় আচার, অনুষ্ঠান, প্রথা ইত্যাদির লক্ষ্য জনকল্যাণ। যদি কোনও প্রথা জনকল্যাণের প্রতিকূল হয়, তাহার পরিবর্তন কাম্য। প্রকৃত ধর্ম তাহাতে বাধা দিতে পারে না। কল্যাণ কীসে, কীসেই বা অকল্যাণ, সেই বিষয়ে সমাজের বোধ কালক্রমে বদলায়। পরিবেশচেতনার বিবর্তন তাহার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। গত কয়েক দশকে এই চেতনার চমকপ্রদ বিকাশ ঘটিয়াছে। নদীর জলে যথেচ্ছ আবর্জনা ফেলিয়া দূষণ ঘটাইলে তাহার পরিণাম ভয়ানক হইতে পারে, এই বোধ ক্রমে জন্মিয়াছে। সেই বোধকে সম্মান দেওয়া জরুরি। মা গঙ্গা অনেক পতিতকে উদ্ধার করিয়াছেন, আপাতত তাঁহাকে অন্তত মৃণ্ময়ীর দায় হইতে অব্যাহতি দেওয়া হোক। যুগের পরিবর্তনের সহিত, ধ্যানধারণার বিবর্তনের সহিত বহু প্রথা এবং আচার বদলাইয়াছে। পশুবলি হইতে চালকুমড়ো বলির প্রথান্তর কম বৈপ্লবিক ছিল না। আর, মাথায় গঙ্গাজল ছিটাইয়া যদি গঙ্গাস্নানের দাবি পূরণ করা যায়, তবে বিসর্জনের নিমিত্ত বিশেষ জলাধার প্রস্তুত করিয়া তাহাতে ঈষৎ গঙ্গাজল ছিটাইয়া সপ্তনদীকে ‘জলে(অ)স্মিন সন্নিধিং কুরু’ বলিলেই বা ভাগীরথী অশুদ্ধ হইবেন কেন? |