শ্যামপুকুর স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে এসে ছেলেটা বেশ কয়েক কদম দুঃখিত ভঙ্গিতে হাঁটল। আর তার পরই তার চোখ আটকে গেল একটা বাসের জানালায়, সে আশ্চর্য হয়ে ভাবল, ‘আরে, সুনীল না?’ স্ফূর্তিতে নেচে উঠল ছেলেটার বুক, তার রাগ জল হয়ে গেল মুহূর্তে, গলার কাছে আটকে থাকা একটা কষ্ট তক্ষুনি বিস্মৃত হল সে, ভাবল অবশেষে সাক্ষাৎ হল, আমার আর সুনীলের। মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। সে ব্যস্তসমস্ত পায়ে ছুটে গিয়ে উঠে পড়ল লাল রঙের চলন্ত দোতলা বাসটায়। বাসটা ভিড়ে ঠাসা। দরজায় ঝুলে ঝুলে কিছুটা গিয়ে ঠেলেঠুলে ভিতরে প্রবেশ করে ছেলেটা ডেকে উঠল, ‘সুনীল, সুনীল?’ লোকজন ঘুরে তাকাল কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। সেই জানালাটার সামনে কোনও মতে পৌঁছে সে দেখল সুনীলের বদলে সেখানে হিটলারের মতো গোঁফঅলা একটা লোক বসে আছে। হিটলারের মতো মানবতার শত্রুকে সে আর সুনীল দু’জনেই চরম ঘৃণা করে এসেছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। ততক্ষণে কলেজ স্ট্রিট এসে গেছে। সুনীল কি তা হলে নেমে গেছে এখানেই? সুনীল কি তাকে দেখেছিল? দেখেও দেখেনি? সত্যিই কি সুনীল তাকে এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে? সে আর সুনীল পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয় পায় মানুষের সঙ্গে মানুষের ভুল বোঝাবুঝিকে, তাদের মধ্যে কখনও ভুল বোঝাবুঝি হয়নি! তা হলে?
ছেলেটা ভগ্নহৃদয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে কফি হাউসে ঢুকে গেল, চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে সে চিৎকার করে উঠল, ‘সুনীল, সুনীল? সুনীল এসেছে?’ এত মানুষ, টেবিলে টেবিলে নারী ও পুরুষের ভিড়, একটা টেবিলের সামনে ‘লাইটহাউস’-এর মতো দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে, ‘নীরা তোমাকে দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়ল।’ ছেলেটা ভাবল এই লাইনটা সারা জীবন তার সঙ্গে ছায়ামূর্তির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে! |
‘সুনীল এসেছিল?’ ছেলেটা ধমক দিয়ে প্রশ্ন করল গোটা কফি হাউসকে। এ বার ঠিক যেন ফাঁকা ঘরের প্রতিধ্বনির মতো একটা ‘না’ শুনতে পেল সে। এত লোক গিজগিজ করছে, এত সিগারেটের ধোঁয়া, তবু সব অদৃশ্য মনে হল কেন? শেষ বার যখন সুনীলের সঙ্গে দেখা হল, সুনীল গোলদিঘির রেলিং-এ ভর দিয়ে তার কাঁধ চাপড়ে বলেছিল, ‘চলো, দিল্লি যাওয়া যাক, হুমায়ুনের সমাধিতে ঘুমিয়ে থাকার অনেক দিনের শখ আমার!’ ‘দিল্লি না হলে নিদেনপক্ষে চাইবাসা।’ বলেছিল সে। ‘বেরিয়ে পড়লেই হল। এখনই যাবে নাকি?’ বলেছিল সুনীল, ‘তার পর যে দিকে দু’চোখ যায়।’ তার পর কত দিন সুনীলের সঙ্গে দেখা হয়নি। সুনীল কি তাকে নির্বাসন দিয়ে নিজে আত্মসমর্পণ করে আছে? এ কি একটা খেলা?
খেলা নিশ্চিত! মাঝে মাঝেই সুনীলকে সে দেখতে পাচ্ছে কলকাতার পথে, ঘাটে, পার্কে, বাসস্টপে, খুনসুটির মতো নগণ্য কত গলিতেও। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে দূর থেকে, কাছে যেতে যেতে সুনীল উধাও। সুনীলের খোঁজে সে হন্যে হয়ে ক্যানিং স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গি ঘুরেছে, সাহাবাবুদের দোকানে গেছে, গেছে তেলিপাড়া লেনে। উত্তর থেকে দক্ষিণে তারাপদ, শক্তি, শরৎ, উৎপলদের বাড়িতে ঢুঁ মেরেছে রাতবিরেতে, শ্যামবাজারে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ফোন করেছে অরুন্ধতীকে, ‘সুনীল কোথায় কেউ জানো?’ অভিমানাহত অরুন্ধতী বলেছে, ‘হয়তো যমুনার কাছে গেছে কিংবা চুম্বন ও অশ্রুজলে ভেজাতে গেছে নীরার পা!’
কেউ কিছু জানে না, ছেলেটার হঠাৎ নিজেকে ভয়ঙ্কর একা মনে হতে থাকে। একা আর পরাজিত। সে কি তা হলে এখন শিশুর মতো ‘সুনীল, সুনীল’ করে কাঁদবে? না কি সদ্য তরুণী কোনও কবির সঙ্গে জলটুঙ্গি বেড়াতে চলে গিয়ে ঈর্ষান্বিত করে তুলবে সুনীলকে? ছেলেটা বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, ‘আমি আর সুনীল, সুনীল আর আমি। আমরা চশমা বদলাবদলি করে পরি, সরমাকে আমরা দু’জনেই ভালবাসতে পারিনি, ও অনেক অনুনয় করা সত্ত্বেও, যদিও আমরা নারীর প্রতি সৌজন্যবশত ওর জন্য তিনটে করে কবিতা রচনা করেছি, নীরাকে আমরা দু’জনেই পাঁচশো করে চিঠি লিখেছি। নিরন্তর লিখে যাচ্ছি, বুক খোলা বুশ শার্টের পকেট থেকে কয়েক তাড়া কবিতা সুনীলকে দিয়েছি আমি, আমাকে সুনীল দিয়েছে একটা চাকরি, কয়েকশো চারমিনার আর কয়েকশো উপন্যাস। সেই সুনীল আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে? ‘সুনীল, তোর মনে পড়ে না?’ লজ্জায় অপমানে মুখচোরা ছেলেটার ঘুষি মারতে ইচ্ছে করে কলকাতার বুকে চেপে-বসা এই শূন্যতাকে! টুঁটি টিপে ধরতে ইচ্ছে করে!
বেলা বেড়ে যাচ্ছে, একটা টানা রিকশার টুংটাং আওয়াজে সংবিৎ ফিরে পেয়ে ছেলেটা দেখল সে দাঁড়িয়ে আছে ‘পারিজাত’-এর নীচের রাস্তায়। সুনীল এখানে থাকলে ন’তলার ফ্ল্যাটটার ওই নির্দিষ্ট জানলাটা দিয়ে অবিরত সিগারেট ধোঁয়ার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যেত! তার শীত করে উঠল। ন’তলায় বেল বেজে যাচ্ছে, ক্রমাগত বেল বেজে যাচ্ছে, দরজার সামনে জমে উঠেছে অজস্র ছোট ছোট পত্রিকা, ব্রাউন পেপারে মোড়া বই নীল গোলাপি লেফাফায় নীরার নারীর চিঠি। সারা কলকাতায় সুনীল নেই। নেই এখানেও!
ছেলেটা বুঝতে পারছে না কেন আজ সমস্ত কলকাতা একটা শ্মশানের দিকে মুখ করে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে? অথবা হেঁটে যাচ্ছে একটা শ্মশান লক্ষ্য করে। সমস্ত রাস্তায় ভিড়, ভিড়ে ভর্তি, অসম্ভব, তার নেশাফেশা কিচ্ছু নেই, কোনও দুঃখ নেই, কারণ অমরত্বকে কবেই তাচ্ছিল্য করা হয়ে গিয়েছে। সে শুধু ভাবছে সেই নিজস্ব গোপন প্রস্থানপথটি কোথাও হারাল সে বা সুনীল?
এ রকম খরখরে দুপুরে কলকাতার ছাদে ছাদে শুকোতে দেওয়া হয় লাল, নীল শাড়ি, হাওয়ায় সেগুলো ওড়াউড়ি করে, মুমূর্ষু রোগীরা হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে এই সময় নার্সদের হাত থেকে ওষুধ খায়, সবাই বাঁচার চিন্তায় মশগুল, বিকেলের সিনেমা আর রাতের ভালবাসা জমাতে চায় মুদ্রার মতো।
ছেলেটা ভিড়ে মিশে যেতে যেতে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল এখন কি কেউ বলছে, ‘বিদায়’? এখন কি কেউ কাউকে বলছে ‘বিদায়, বিদায়’? বিদায়ের বদলে সে শুনতে পেল এক নারীর আকুতি সুনীল, হারিয়ে যেয়ো না! |