এ বার সংগঠনে নজর দেবেন রাহুল
যোগ্যতা ও রাজনীতির ভারসাম্যেই রদবদল
লতে পাকানোর কাজটি শুরু হয়েছিল সে দিন, যে দিন রাষ্ট্রপতি ভবনের বাসিন্দা হলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার পরই পি চিদম্বরমকে ফের অর্থ মন্ত্রকে এনে আর সুশীল শিন্দেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় রদবদলের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন মনমোহন সিংহ এবং সনিয়া গাঁধী। আজ সেই প্রক্রিয়া শেষ হল। লোকসভা নির্বাচনের আগে এই শেষ বড় রদবদলে এক দিকে পেশাদারি যোগ্যতা, অন্য দিকে রাজনৈতিক কৌশলের মেলবন্ধন ঘটল।
প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণকে নিয়ে বহু দিন ধরেই তিতিবিরক্ত ছিলেন মনমোহন। কিন্তু নানা কারণে তাঁকে সরানো যাচ্ছিল না। এ বার কৃষ্ণ সরলেন। তাঁর জায়গায় অক্সফোর্ড-ফেরত উত্তরপ্রদেশের অভিজাত মুসলিম নেতা সলমন খুরশিদকে আনার প্রধান কারণ: যোগ্যতা। তা ছাড়া, বিদেশ মন্ত্রকে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে সলমনের। নরসিংহ রাওয়ার আমলে বিদেশ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। সলমনের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন।
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খুরশিদ আলমের ছেলে সলমনকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ‘বিগ ফোর’-এ (প্রধান চারটি মন্ত্রক: স্বরাষ্ট্র, অর্থ, বিদেশ ও প্রতিরক্ষা) এনে আসলে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চেয়েছেন মনমোহন। কংগ্রেস জমানায় এই প্রথম কোনও মুসলিম মন্ত্রী নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার কমিটি ও দলের কোর গ্রুপের সদস্য হলেন। যেটা সংখ্যালঘুদের প্রতি একটা বার্তা। পাশাপাশি, অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের তোলা দুর্নীতির অভিযোগকে তোয়াক্কা না করে তাঁদের পালের বাতাস কাড়ার চেষ্টা করলেন মনমোহন।
শুধু সলমন নন। শশী তারুরের বিরুদ্ধেও এর আগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। তাঁকেও তাই মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ঘটনা হল, কংগ্রেসের এই কড়া অবস্থানে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে বিজেপি। কারণ, তাদের সভাপতি নিতিন গডকড়ীর বিরুদ্ধেও তো দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে টিম কেজরিওয়াল।
যোগ্যতার মাপকাঠিতে আজ আরও অনেক মন্ত্রীর দফতর বদল হয়েছে। যেমন, কপিল সিব্বলকে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক থেকে সরানোর জন্য দীর্ঘদিন ধরেই মনমোহন ও সনিয়ার কাছে দরবার করছিলেন শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট জনদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি ছিল, অহেতুক সংস্কার করতে গিয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে আসছেন সিব্বল। কংগ্রেসও মনে করছে, টুজি কেলেঙ্কারি কাণ্ডের পর টেলিকম দায়িত্ব নিয়ে সেখানে অনেক স্বচ্ছতা আনতে পারলেও মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকে তিনি ব্যর্থ। তাই সেই মন্ত্রকে আনা হল প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী এম এম পল্লম রাজুকে। তবে তিনিও সফল হবেন কি না, তা নিয়ে কিছুটা হলেও সংশয় রয়েছে সরকারের একাংশেই।
জয়পাল রেড্ডিকে তেল মন্ত্রক থেকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকে সরানোর কারণ হিসেবে অম্বানী গোষ্ঠীর আস্থাভাজন না হওয়ার কথা কোনও কোনও মহল থেকে বলা হলেও কংগ্রেস কিন্তু বলছে, তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। শুধু তেল নয়, এর আগে নগরোন্নয়ন মন্ত্রকেও বিশেষ কাজ করতে পারেননি জয়পাল। তাঁর জায়গায় তেল মন্ত্রকে এসেছেন দশ জনপথ ঘনিষ্ঠ বীরপ্পা মইলি।
একই রকম ভাবে নিজের মন্ত্রকে ব্যর্থ হওয়ায় এবং রেল মন্ত্রকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়ে দাগ কাটতে ব্যর্থ হওয়ায় সি পি জোশীকে সরিয়ে রেলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ পবন বনশলকে। তাঁর জায়গায় সংসদীয় মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন কমল নাথ। কমল নাথের সঙ্গে সমস্ত দলের নেতাদের সুসম্পর্ক রয়েছে। এনডিএ জমানায় প্রমোদ মহাজন বিভিন্ন দলের সঙ্গে সমন্বয়ের যে কাজটি করতেন, কমল নাথ তা করতে পারবেন বলেই আশাবাদী দল।
মন্ত্রিসভায় আজকের রদবদল থেকে দু’টি জিনিস স্পষ্ট। প্রথমত, আর্থিক সংস্কারের ব্যাপারে সরকার যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তা বোঝা যাচ্ছে অজয় মাকেন, মণীশ তিওয়ারির মতো সংস্কারপন্থী নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ায়। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রিসভার উপরে সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেলের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমেছে। সলমন খুরশিদের সঙ্গে আহমেদের সম্পর্ক মধুর নয়। সলমনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে মন্ত্রিসভায় তাঁর গুরুত্ব কমানোর
জন্য সরব হয়েছিলেন আহমেদ। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। অহমেদ পটলের ঘোষিত বিরোধী বলে পরিচিত গুজরাতের দিনশা পটেলেরও খনি দফতরের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি হয়েছে আজ।
এর আগে মন্ত্রিসভার রদবদলের সময় মনমোহন, সনিয়ার সঙ্গে সমান ভাবে সক্রিয় থাকতেন আহমেদ। কিন্তু এ বার তিনি ব্যস্ত গুজরাতের বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে। আহমেদের গুরুত্ব কমার পিছনে রাহুল গাঁধীর ভূমিকা রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বস্তুত, মন্ত্রিসভায় না এসে দলীয় সংগঠনের উপরে নিজের কর্তৃত্ব আরও মজবুত করেছেন রাহুল। সংগঠনের রদবদল যে আসন্ন, সে কথা আজই জানিয়ে দিয়েছেন সনিয়া। মনমোহনও বলেছেন, রাহুল মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে খুশি হতাম। কিন্তু তিনি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে চান।” সনিয়াও মনে করছেন, দল ও সরকার এক সঙ্গে দু’টি দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করা সম্ভব নয়। এতে কোনও কাজের প্রতিই সুবিচার করা সম্ভব হয় না।
তবে রাহুল-ঘনিষ্ঠ সচিন পাইলট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী এবং লালচাঁদ কাটারিয়া বা নিনঙ্গ এরিংকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে আজ। যাঁরা মন্ত্রিসভায় রাহুলের মুখ। কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, এঁদের সুযোগ দিয়ে বাজিয়ে দেখেও নিচ্ছেন রাহুল। যাতে আগামী লোকসভা ভোটে কংগ্রেস জিতলে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য বাছা সহজ হয়।
আজকের রদবদলের আরেকটি রাজনৈতিক দিক হল অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে নতুন ছ’জনকে মন্ত্রী করা। তেলেঙ্গানা সমস্যা ও জগন্মোহনের বিদ্রোহে ওই রাজ্যে বেশ খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে কংগ্রেস। নতুন মন্ত্রী দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা চালাল তারা। তেলেঙ্গানাকে বার্তা দিতে এস সত্যনারায়ণের মতো দলিত নেতাকে আনা হয়েছে। মন্ত্রী হয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় ভাস্কর রেড্ডির ছেলে সূর্য প্রতাপ রেড্ডি। অন্ধ্রে কংগ্রেস সরকারকে অক্সিজেন জুগিয়ে স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন প্রজা রাজ্যম পার্টির প্রধান অভিনেতা চিরঞ্জীবী।
তবে মন্ত্রিসভার রদবদল করে চলতি সঙ্কট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা কংগ্রেস করেছে, তা সফল হবে কি না সেটা নির্ভর করছে আগামী দেড় বছরে সরকারের কাজের উপর।
তা ছাড়া, রাহুলের নেতৃত্বে রাজ্যে রাজ্যে কী রণকৌশল কংগ্রেস নেবে তার প্রভাবও পড়বে আগামী লোকসভা নির্বাচনে।
রাজনীতির কারবারিদের কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, ১৯৬৩ সালে কামরাজ প্ল্যান (দল ও মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল। অনেক মন্ত্রীকে দলের কাজে নিয়ে আসা) প্রয়োগ করলেও ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল কংগ্রেসের পক্ষে যায়নি। রাজীব গাঁধীও ১৯৮৮ সালে কামরাজ পরিকল্পনার ধাঁচে রদবদল করে পরের বছর নির্বাচনে হেরে যান।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আটকানোই চ্যালেঞ্জ সনিয়া-রাহুল-মনমোহনের।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.