|
|
|
|
মর্গ্যানকে জন্মদিনের উপহারে ভিজিয়ে দিল দল |
রতন চক্রবর্তী • শিলিগুড়ি |
ডেম্পো-২ (ক্লাইম্যাক্স, মহেশ)
ইস্টবেঙ্গল-৩ (অর্ণব, মননদীপ, চিডি) |
খেলা শুরুর ছ’ঘণ্টা আগে ফেড কাপ ফাইনালে ফেভারিট কে, জানতে চাওয়া হয়েছিল টোলগে ওজবে আর র্যান্টি মার্টিন্সের কাছে।
লাল-হলুদ জার্সি ছেড়ে আসা টোলগে এসএমএসে জানিয়েছিলেন, “ট্রেভরের ম্যাচ রিডিং অসাধারণ। তবে ওপারা-গুরবিন্দরের অভাবটা কী ভাবে ইস্টবেঙ্গল সামলায় সেটার ওপর রেজাল্ট নির্ভর করবে।”
আর ডেম্পো ছেড়ে আসা র্যান্টির ব্যাখ্যা ছিল, “আর্মান্দোর চেয়ে ট্রেভর বড় ট্যাক্টিসিয়ান। সে জন্যই ইস্টবেঙ্গল ফেভারিট।”
দেশের দুই সেরা স্ট্রাইকার তাঁদের পুরনো কোচের মূল্যায়নে যে কতটা অভ্রান্ত, সেটা রবিবার রাতে জ্বলজ্বল করল কাঞ্চনজঙ্ঘায়। দু’ঘণ্টার তীব্র উপভোগ্য যুদ্ধ শেষে।
দুর্গাপুজোর কুড়ি দিন আগেই ট্রফি-বোধন হয়ে গেল ইস্টবেঙ্গলে। শিলিগুড়ি থেকে ফেড কাপকে লাল-হলুদ রঙে ভিজিয়ে গোষ্ঠ পাল সরণিতে নিয়ে যাচ্ছে ‘বাংলার ম্যান ইউ’। এবং বলতে দ্বিধা নেই সেটা ব্রিটিশ কোচের সৌজন্যেই। মর্গ্যান জমানায় কটকে জেতা ফেড কাপ কলকাতায় হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। বাংলারই আর এক ফুটবলের শহর থেকে সেটা ফিরে এল। এমন একটা দিনে ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব মুঠোয় পুরল ইস্টবেঙ্গলযে দিনটা আবার তাদের কোচের ছাপ্পান্নতম জন্মদিন। এর চেয়ে ভাল ‘বার্থ ডে গিফ্ট’ আর কী পেতে পারতেন একজন কোচ তাঁর প্লেয়ারদের থেকে? ম্যাচ শেষে দেখা গেল, সঞ্জু-মেহতাব-খাবরা-পেনরা কোচকে আকাশে তুলে ধরছেন হাত-হাত লাগিয়ে। চিৎকার করছেন, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ বলে। কোচকে নিয়ে ফুটবলারদের লোফালুফি চলছে এক দিকে। অন্য দিকে চিডি-সৌমিকরা নিজেদের জার্সি ওড়াতে ওড়াতে চক্কর দিচ্ছেন পুরো মাঠ। তাঁদের পিছনে পিলপিল করে ছুটছে লাল-হলুদ জনতা। |
|
মধ্যমণি কোচ। ট্রফি নিয়ে লাল-হলুদ টিম। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
দেশের দুই সেরা কোচের স্ট্র্যাটেজির ঝনঝনানিতে ম্যাচটা হাড্ডাহাড্ডি হলেও উপভোগ্য হবে আশা করেননি অনেকেই। তবে ট্রেভর মর্গ্যান এবং আর্মান্দো কোলাসোর হাতে থাকা রিমোটের কোন বোতামে কখন হাত পড়ে সেটার জন্যই ছিল অপেক্ষা। নির্ধারিত সময়ে ম্যাচ ১-১ থাকার পর শুরু হল আসল ‘যুদ্ধ’। আস্তিনে লুকনো তাস ফেলতে শুরু করলেন দুই কোচই। মর্গ্যান নামালেন সঞ্জু আর লালরামডিকাকে। আর্মান্দো সুয়েকা এবং রোমিওকে। চারটেই প্রত্যাশিত বদল। কিন্তু মাঠে তাঁদের সঠিক ব্যবহারে এগিয়ে গেলেন লাল-হলুদ কোচই। আর্মান্দো স্ট্রাইকারে সুয়েকাকে পাঠিয়ে জোয়াকিম আব্রাঞ্চেজকে পিছিয়ে এনেছিলেন মাঝমাঠে। কিন্তু সেই বদল উল্টে সাহায্য করল মেহতাব-পেনদেরই। চোট সারিয়ে ফেরা সুয়েকা বৃষ্টি ভেজা মাঠে কার্যকরী হলেন না। ফলে জোয়াকিম-কোকো যে চাপটা এতক্ষণ রেখেছিলেন ইস্টবেঙ্গল রক্ষণে, সেটা আলগা হয়ে গেল। ক্লাইম্যাক্স, ক্লিফোর্ড, অ্যান্টনিরা বহু দিন খেলছেন। কেউ পনেরো বছর, কেউ আঠারো। বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা সময় পর্যন্ত লড়া যায়। কিন্তু বয়স্ক শরীর? সেটা কতক্ষণ লড়বে? অতিরিক্ত সময় শুরু হতেই ডেম্পোর মাঝমাঠের মুঠি ক্লান্তিতে আলগা হতে শুরু করল।
চতুর মর্গ্যান যেন এই সময়টার অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি জেতার জয়যাত্রায় দুই উইং দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর দুই টাট্টুঘোড়াকে। সঞ্জু আর ডিকা দু’জনই পাহাড়ি ছেলে। অসম্ভব তেজ। নাছোড় লড়াইয়ের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে মিজো-সিকিমিজদের মধ্যে। সেটাই আজ মাঠে ঝলসাল। পাল্টে দিল ম্যাচের রং। সঞ্জু থেকে ডিকা বল পেয়েই জোরাল শট নিয়েছিলেন। ডেম্পো কিপার শুভাশিসের হাতে লেগে ফিরতেই মননদীপের ২-১ করার মহাগুরুত্বপূর্ণ গোল।
মরিয়া ডেম্পো কোচ তাঁর জনাদুয়েক ‘সৈন্য’ নিজের গোলের সামনে রেখে বাকি সবাইকে বিপক্ষ বক্সে পাঠিয়ে দিলেন ম্যাচে ফেরার তীব্র আকাঙ্খায়। আর সেই সুযোগে প্রতিআক্রমণে চিডির গোল। নিশ্চিন্তের ৩-১ থেকে বিপজ্জনক ৩-২ হয়ে যাওয়াটা অপ্রত্যাশিত। তবে মহেশ গাউলি গোলটা করার আগেই অবশ্য উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল লাল-হলুদ গ্যালারিতে। বাকিটা ঘড়ি দেখার পালা। জুনিয়র-ফ্যাক্টর এ বারও তাড়া করল ডেম্পোকে। পাঁচবার আই লিগ জেতা টিমের কাছে ফেড কাপ ‘আতঙ্কের’-ই হয়ে থাকল। আর ইস্টবেঙ্গল ‘পাঁচে নয় আটে আছি’ বলে ফেড কাপ তুলে নিল টিম বাসে।
সকাল থেকে একটা টিকিটের জন্য হাহাকার। পরিকাঠামোর সমস্যা থাকলেও টিকিট নিয়ে কোনও গণ্ডগোল নেই। কালোবাজারি রুখতে পুলিশের নজরদারি ছিল স্টেডিয়াম চত্বর জুড়ে। ম্যাচ শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টা আগেই তিরিশ হাজারের কাঞ্চনজঙ্ঘায় উৎসব। শিলিগুড়ি ইস্টবেঙ্গলের শহর। ভারত-পাকিস্তানের চিরদিনের ক্রিকেট ম্যাচ চলছে কলম্বোয়এখানে কে বলবে? লাল-হলুদ রং মেখে মাঠে এসেছিলেন অনেকেই। বহু মহিলাও। সঙ্গে বিভিন্ন ব্যানার। বহুদিনের বাক্সবন্দি ভুভুজেলাও বাজতে শোনা গেল।
ম্যাচ শুরুর মিনিট দশেক আগে বৃষ্টি নেমেছিল। পাহাড় থেকে উড়ে আসা মেঘে। তাতে দুই কোচের শান দিয়ে আসা স্ট্র্যাটেজিতে যেন সামান্য মরচে ধরল। ভিজে মাঠে আছাড় খেতে লাগলেন দু’দলের ফুটবলারই। ফলে প্রথমার্ধে স্বাভাবিক ছন্দ পাচ্ছিল না দু’দল। পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ম্যাচ দুলল পেন্ডুলামের মতো। এ-দিক থেকে ও-দিক। কিন্তু লাল-হলুদ জার্সি পরে যাঁর পেন্ডুলাম হওয়ার কথা, মর্গ্যানের দলের সেই হৃদপিণ্ড পেন ওরজির পিছনে ছিল জোনাল মার্কিং। ইস্টবেঙ্গল কোচ তাঁর মাঝমাঠের সেরা অস্ত্র মেহতাবকে ব্যবহার করেছিলেন দু’টো কাজে। স্টপারে নতুন-জুটি রাজু-অর্ণবের সামনে একটা দেওয়াল তুলে ধরতে। সঙ্গে নিজেদের রক্ষণ থেকে বল নিয়ে খেলাটা তৈরি করতে। কলকাতায় গত ফেড কাপ ফাইনালে নেমে তিন মিনিটের মধ্যে চোট পেয়ে বসে পড়েছিলেন। সেই আক্ষেপ এখনও আছে মেহতাবের। সেটা যেন সুদে-আসলে পোষাতে নেমেছিলেন বারুইপুরের ছেলে।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ক্লাইম্যাক্স লরেন্সের অসাধারণ গোলে এগিয়ে যায় ডেম্পোই। দীর্ঘ দিন ভারতীয় দলে খেলে অবসর নিয়েছেন। বক্সের মধ্যে থেকে তাঁর গোলটা করা দেখে মনে হল আগুনটা পুরোদস্তুরই আছে। দশ মিনিটেই অবশ্য ইস্টবেঙ্গলের গোল শোধ। মেহতাবের কর্নার ব্যাক হেড করে গোলে পাঠান অর্ণব। ক্লাইম্যাক্সের মতোই ‘আনমার্কড’ ছিলেন অর্ণব। হেড করে কালীঘাটের ফাঁড়া কাটিয়ে অর্ণব বোঝালেন ‘দুর্ঘটনা’ রোজ রোজ ঘটে না! ট্রফি জেতার দিনে তো নয়ই!
ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, নওবা, রাজু, অর্ণব, সৌমিক, খাবরা (লালরিনডিকা), মেহতাব, পেন, ইসফাক (সঞ্জু), মননদীপ, চিডি (রবার্ট)।
|
চিডিদের জন্য ক্লাবের পুরস্কার ৮ লাখ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
|
মর্গ্যানের কোচিংয়ে পরপর তিনবার ফেড কাপ ফাইনাল খেলে দু’বার চ্যাম্পিয়ন ইস্টবেঙ্গল। উচ্ছ্বসিত লাল-হলুদ কর্তারা ফুটবলারদের ৮ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করলেন রবিবার রাতেই। এই পুরস্কার আই লিগের আগে চিডি-মেহতাবদের কাছে বড় অনুপ্রেরণা হবে বলে মনে করছেন কর্তারা। অন্যতম শীর্ষ কর্তা দেবব্রত সরকার তো বলেই দিলেন, “আমাদের ছেলেদের জন্য আমরা গর্বিত। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে ফুটবলার-কোচ প্রত্যেকেই। যাঁরা ম্যাচ গড়াপেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তাঁদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আর্মান্দো কোলাসোকে যেন একবার জিজ্ঞেস করে নেন ফাইনাল ম্যাচটাও গড়াপেটা হয়েছে কি না!” |
|
|
|
|
|