মহারাষ্ট্রের উপ-মুখ্যমন্ত্রী অজিত পওয়ারের ইস্তফা গৃহীত হইয়াছে। এই ইস্তফা-পর্বটি এন সি পি-কংগ্রেসের জোট সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফল নহে। ইহা একান্ত ভাবেই এন সি পি-র নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের বিস্ফোরণ এন সি পি-তে শরদ পওয়ারের কর্তৃত্বের প্রতি তাঁহার ভাইপো অজিত পওয়ারের অনাস্থার পরিণাম। অনুমান করা কঠিন নয় যে, অজিত পওয়ার অনন্ত কাল পিতৃব্য শরদের ছায়া হইয়া থাকিতে অনিচ্ছুক। তিনি দলের ও রাজ্যের শীর্ষ ক্ষমতা হাসিল করিতে অধৈর্য হইয়াছেন। শরদ-কন্যা সুপ্রিয়া সুলে-র রাজনৈতিক অভিষেক হইতেই তিনি আপন ভবিতব্য বুঝিয়া যান। খুড়তুতো বোনের অনুগামী হইয়া রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করিতে তিনি সম্ভবত নারাজ। তাই তাঁহার মনে হইয়াছে, এখনই একটা হেস্তনেস্ত করিয়া ফেলিতে না পারিলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অভীষ্ট লক্ষ্য সিদ্ধ করিতে তিনি ব্যর্থ হইবেন। অতএব ইস্তফা। এমন একটি কার্যকারণসূত্র রাজনীতিতে স্বাভাবিক, ‘যুক্তিযুক্ত’ও বটে।
অজিত পওয়ারের এই সিদ্ধান্তের ফলে মহারাষ্ট্রের শাসক জোটেও যে স্থিতির সমস্যা সৃষ্টি হইবে, তাহাতে সংশয় নাই। কারণ এন সি পি-র বিধায়কদের একটি বড় অংশ শরদ পওয়ারের বদলে অজিত পওয়ারের সহকর্মী হইতে ইচ্ছুক। গরিষ্ঠতার পাটিগণিত লইয়া পরীক্ষা শুরু হইলে কংগ্রেস-এন সি পি শাসক জোট সমস্যায় পড়িতে বাধ্য। তবে বিরোধী শিবিরও যে খুব নিশ্চিন্ত, তাহা নহে। মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে কাকা-ভাইপোর দ্বন্দ্ব তো কেবল এন সি পি নহে, অন্যান্য দলকেও দীর্ণ করিতেছে। শিবসেনার বিভাজন অনেক দিন ধরিয়াই সকলের চোখের সামনে উদ্ভাসিত। ২০০৫ সালে বালাসাহেব ঠাকরে তাঁহার পুত্র উদ্ধবকে মরাঠি খণ্ডজাতীয়তার যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলে ক্ষুব্ধ ভ্রাতুষ্পুত্র রাজ ঠাকরে পিতৃব্যর বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহে অবতীর্ণ হন। তাঁহার ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’ ক্রমেই শিবসেনার সমর্থনের মাটিতে ধস নামাইতেছে। রাজ্যের অন্য বিরোধী দল বি জে পি-র অবস্থাও তথৈবচ। প্রবীণ দলনেতা গোপীনাথ মুণ্ডের সহিত তাঁহার ভাইপো ধনঞ্জয় মুণ্ডের বিরোধের হেতুও পিতৃব্যের তরফে কন্যা ‘পঙ্কজা’কে উত্তরসূরি মনোনীত করার প্রয়াস। ধনঞ্জয় পরিবারতন্ত্রের এই সংস্করণটি শিরোধার্য করিতে পারেন নাই। বি জে পি-র মরাঠি সংগঠনের শিরোমণি হিসাবে নিজেকে তুলিয়া ধরিতেই তাঁহার আগ্রহ বেশি। আর বিজেপির বিধায়ক-নেতা এবং তৃণমূল স্তরের কর্মী-সমর্থকদের বৃহদংশও তাঁহার সঙ্গেই থাকায় গোপীনাথকে লইয়াও বিজেপি সমস্যায় রহিয়াছে। দল ভিন্ন, সমস্যা অভিন্ন। সমস্যার পারিবারিক বিন্যাসটিও।
পরিবারতন্ত্র এ দেশের রাজনীতিতে নানা ভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরা নিজেদের পুত্রকন্যাদের উত্তরাধিকারী মনোনীত করায় রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ভাইপোরা তাহার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাইতেছে, দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী, অন্তত তরুণতর প্রজন্মের কর্মী-সমর্থকরা দলপতির আত্মজ বা আত্মজার প্রতি নহে, অন্য পরিজনের প্রতিই পক্ষপাত দেখাইতেছেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্ররা তো কেবল মহাভারতের আখ্যানে থাকেন না, ভারতীয় রাজনীতির আখ্যানও তাঁহারাই আলো করিয়া রাখিয়াছেন। তাই আত্মজকেই দলীয় নেতৃত্বের ও শাসনপ্রণালীর উত্তরাধিকার সঁপিবার ব্যগ্রতা হইতে রাজনীতিকরা কদাচিৎ মুক্ত থাকিতে পারেন। তাহাতে প্রায়শ দলে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়, কখনও কখনও দল ভাঙিয়াও যায়, তথাপি রাজনীতিকরা নিরপেক্ষ, নির্মোহ হইতে পারেন না। ধৃতরাষ্ট্রের দৃষ্টিহীনতা কেবল আক্ষরিক বা শারীরিক ছিল না। ইহা আলঙ্কারিকও কর্তৃত্বপরায়ণ কুলপতির রাজনৈতিক অন্ধত্বের রূপক যাহার অন্দরে নিহিত। |