শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তর সম্পাদকীয় ‘কারাটদের এ বার জাতপাতের...’ (৪-৯) পড়ার পর নানা কারণে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণিদের রাজনীতির ভাষা যে ক্রমশ বদলাচ্ছে, সে বিষয়ে লেখকের বিশ্লেষণ সমর্থনযোগ্য হলেও লেখাটি দু-একটি জায়গায় পরিমার্জনা দাবি করে। প্রথমত, কমিউনিস্ট নেতৃত্বে সংগঠিত ছেচল্লিশের তেভাগা আন্দোলনে তিনি নমঃশূদ্র ও রাজবংশীদের যে অংশগ্রহণের কথা বলেছেন, তা আংশিক ভাবে দোষদুষ্ট। সকলেই জানেন, তেভাগার অন্যতম কেন্দ্র ছিল কাকদ্বীপ তথা সুন্দরবনের বাদা অঞ্চল। এখানকার জনগোষ্ঠী মূলত পৌণ্ড্র সম্প্রদায়ভুক্ত। কাকদ্বীপ তথা চন্দনপিঁড়ি কেন্দ্রিক আন্দোলনের নেতা ছিলেন কংসারী হালদার। যিনি ওই সম্প্রদায়ের মানুষ। ১৯৪৮-এর অক্টোবরে চন্দনপিঁড়ি গ্রামে অহল্যা নামে যে কৃষকবধূ তেভাগায় প্রাণ দিয়েছিলেন (যাঁকে ঘিরে সলিল চৌধুরীর ‘কাকদ্বীপ’ কবিতা) তিনিও ছিলেন পৌণ্ড্র সমাজের। ওই অঞ্চলের অধিকাংশ চাষিই উক্ত সমাজভুক্ত। তেভাগা নিয়ে যাঁরা উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ ও গ্রন্থ লিখেছেন, সেই নরহরি কবিরাজ, হেমন্ত ঘোষালরাও স্বীকার করে গেছেন ওই আন্দোলনে পৌণ্ড্র সমাজের মানুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা। এটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য যে, পৌণ্ড্ররা দীর্ঘ দিন ধরেই কৃষিজীবী (স্মরণীয়, আঠারো শতকের কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবসংকীর্তন’: ‘দেবতার পোদবৃত্তি বড়ই লঘুতা’)।
দ্বিতীয়ত, জাতিভেদ প্রথা উচ্ছেদের ব্যাপারে জ্যোতিরাও ফুলে এবং ভীমরাও অম্বেডকরের আন্দোলন তেমন জোরদার ছিল না, এ কথা সর্বাংশে সত্য নয়। ১৮৭৩ সালে পুণেতে মহাত্মা ফুলে ‘সত্যসাধক সমাজ’ নাম দিয়ে জাতিভেদের বিরোধিতায় আত্মসম্মানবোধের (সেল্ফ রেসপেক্ট) আন্দোলন শুরু করেন। তাতে অনেক মানুষ বিশেষ করে মালি জনগোষ্ঠী সংগঠিত হয়। মহার ও অন্যান্য অন্ত্যজ গোষ্ঠী নিয়ে অম্বেডকরের আন্দোলন ছিল আরও সংহত ও জোরালো। জাতব্যবস্থার বিরোধিতা করে লেখা তাঁর বিখ্যাত বই ‘Annihilation of caste’. অস্পৃশ্যদের উন্নয়নের জন্য সামাজিক আন্দোলনে তিনিই ধ্বনি তোলেন, ‘Educate; Agitate and Organise’. অবৈজ্ঞানিক জাতব্যবস্থাই যে অস্পৃশ্যতার জন্ম দিয়েছে, এই সত্য বাবাসাহেব উপলব্ধি করে বারবার জাতিভেদ প্রথাকে আক্রমণ করেছেন। চৌদার পুকুর অভিযান থেকে শুরু করে মন্দির প্রবেশ আন্দোলন, এমনকী বর্ণবাদের ভিত ‘মনুসংহিতা’র বহ্ন্যুৎসব তাঁর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার দায়িত্ব পান তিনি। তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষদের জন্য সংরক্ষণের রক্ষাকবচ তাঁরই সৃষ্টি।
তবে লেখকের সঙ্গে একমত যে, আজকের রাজনীতির ভাষা নানা কারণে বদলেছে। মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ উচ্চবর্ণভুক্ত নন। অথচ বাকি ১৫ শতাংশ মানুষের হাতেই কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে অর্থ, প্রতিপত্তি, চাকুরি ও ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতি। এখন এই দলিত ও অনগ্রসর শ্রেণিকে যদি কোনও রাজনৈতিক দল গুরুত্ব না দেয়, তা হলে উন্নয়নের ফাঁকা বুলিতে আজ আর কাজ হবে না। দলিতরা যে দিকে দিকে সংগঠিত হচ্ছেন তা সর্বভারতীয় ও প্রাদেশিক ক্ষেত্রগুলিতে দেখা যাচ্ছে। অচিরে তাদের শক্তিময় আত্মপ্রকাশ আসন্ন।
সনৎকুমার নস্কর।
সভাস্থবির, পৌণ্ড্র মহাসঙ্ঘ, সোনারপুর, কলকাতা-১৫০
|
কথা ছিল ফের বিমান উড়বে। তাই বছর চারেক আগে মুণ্ডচ্ছেদ করা হয়েছিল কোচবিহার বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী শিরীষ গাছগুলোর। শতবর্ষপ্রাচীন প্রকাণ্ড এই গাছগুলো ছিল কয়েক হাজার সারস, শামুকখোল পাখির নিশ্চিন্ত নিবাস। ওদের উচ্ছেদের বিনিময়ে বিমান উড়ল চার বছরে সাকুল্যে চার দিন। এর পর স্তব্ধ হয়ে গেল সব ওড়াউড়ি।
মুণ্ডিত কাণ্ডে এ বার শাখা গজিয়েছে। এসেছে নতুন পাখি। এখন ওদের ভাল বাসা নেই। তবুও আছে নিরন্তর ভালবাসা। বাসযোগ্য জায়গা পেলে হয়তো আবার বাঁধবে বাসা।
আশুতোষ চক্রবর্তী। বি ডি বাইলেন, কোচবিহার-৭৩৬১০১ |